বিশ্ব

ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির ঘোষণা: শান্তির সূচনা, না সাময়িক বিরতি?

পাকিস্তানের হায়দরাবাদে মানুষজন যখন রাস্তায় নেমে যুদ্ধবিরতির আনন্দে উদ্‌যাপন করছেন, তখন অনেকেই মনে করছেন—এই ঘোষণার পেছনের বাস্তবতা আসলে কী? ভারত ও পাকিস্তান, এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী গত কয়েক দিনে এমন এক উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে, যার পরিণতি হতে পারত পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ। তবে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ঘোষিত এক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে আপাতভাবে কমেছে এই উত্তেজনা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী হবে? এবং দুই দেশের মধ্যে আসলেই কি শান্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে?

সংঘর্ষ, অভিযানে উত্তপ্ত উপমহাদেশ

গত কয়েক দিনে ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। ভারতের পক্ষ থেকে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং পাকিস্তানের ‘অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস’ ছিল আলোচিত। এই অভিযানে উভয় পক্ষই জানায়, তারা বেশির ভাগ হামলা প্রতিহত করেছে, তবে কিছু হামলায় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।

ভারতের দাবি অনুযায়ী, পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে অবস্থিত “সন্ত্রাসী ঘাঁটি” লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে এবং এতে ৬০ জনের বেশি নিহত হয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান দাবি করেছে, ভারতের হামলায় নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে তাদের অন্তত ১৩ জন নাগরিক নিহত হয়েছে।

এমন পাল্টাপাল্টি হামলার প্রেক্ষাপটে গোটা অঞ্চলে একপ্রকার যুদ্ধের আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে।

ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি

গত শনিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন, ভারত ও পাকিস্তান একটি পূর্ণাঙ্গ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।

তিনি লেখেন, “সাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও অসাধারণ কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ব্যবহার করার জন্য দুই দেশকেই অভিনন্দন। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ!”

ট্রাম্পের ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এবং ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এই ঘোষণার পর উভয় দেশের সেনাবাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যেন তারা স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে সব ধরনের সামরিক অভিযান বন্ধ রাখে।

পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, ভারত ও পাকিস্তান একটি নিরপেক্ষ স্থানে বিস্তৃত ইস্যুতে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছে। তবে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এই দাবিকে পুরোপুরি স্বীকার করেনি। তারা বলেছে, আলোচনা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বিশ্লেষক সুবীর সিনহা জানান, ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় আলোচনা বরাবরই কঠিন বিষয়। মোদি সরকারের বর্তমান ‘কঠোর পাকিস্তাননীতি’র প্রেক্ষিতে আলোচনায় বসা সহজ সিদ্ধান্ত নয়। এর ফলে দেশের ডানপন্থী গোষ্ঠীর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।

যুদ্ধ না কি সামরিক অভিযান?

আন্তর্জাতিক আইনবিদ আহমের বিলাল সুফি বলেন, ১৯৪৫ সালের পর থেকে বেশিরভাগ দেশ যুদ্ধ ঘোষণা না করেই সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। কারণ, আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলে তা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ শক্তি প্রয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ভারত ও পাকিস্তানও তাদের সাম্প্রতিক অভিযানগুলোকে যুদ্ধ না বলে সামরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন করেছে। পাকিস্তানের “বুনিয়ান-উন-মারসুস” অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় ভারত তাদের ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে। এই সবকিছুর শুরু ২২ এপ্রিল, যখন কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার জন্য ভারত পাকিস্তান-ভিত্তিক একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দায়ী করে।

দুই দেশের পুরনো চুক্তিগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক?

বিশ্লেষকদের মতে, যদি যুদ্ধ-পরবর্তী উত্তেজনা প্রশমিত করতে হয়, তবে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি ও সিমলা চুক্তিকে পুনরায় কার্যকর করতে হবে। ভারত ইতোমধ্যে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে এবং পাকিস্তান সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার হুমকি দিয়েছে।

সুবীর সিনহার মতে, এই দুই চুক্তিকে আলোচনার ভিত্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেই কেবল ভবিষ্যতের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তিপথ তৈরি হতে পারে।

তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার ইতিহাস

ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ নতুন কিছু নয়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় প্রথম যুদ্ধবিরতি হয়। ১৯৬৬ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের ইতি ঘটে।

১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে চাপ দিয়ে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য করেন। ২০০২ সালে কলিন পাওয়েলের মধ্যস্থতায় নিয়ন্ত্রণরেখার উত্তেজনা প্রশমিত হয়।

এই ইতিহাস বলছে, বাইরের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ অনেক সময় ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ কী?

যদিও যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়েছে, কিন্তু এর স্থায়িত্ব নিয়ে রয়েছে নানা সংশয়। রাজনৈতিক ও সামরিক উসকানি, কাশ্মীর ইস্যু, সন্ত্রাসবাদ ও সীমান্ত লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলো এই সমঝোতাকে যে কোনো সময় ভঙ্গুর করে দিতে পারে।

এখন দেখার বিষয়, দুই দেশ শান্তির পথকে কতটা গুরুত্ব দেয় এবং আন্তর্জাতিক মহল এই যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়নে কতটা সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button