বিশ্ববাজারে ডলারের পতন: ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে বড় ধস

২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ডলারের দাম বিশ্ববাজারে ১০ শতাংশেরও বেশি কমেছে, যা ১৯৭৩ সালের পর এই মুদ্রার সর্ববৃহৎ পতন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোর মুদ্রার তুলনায় ডলারের অবমূল্যায়ন বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে।
১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র স্বর্ণমান থেকে মুক্ত হয়ে ফ্লোটিং মুদ্রা ব্যবস্থায় যাত্রা শুরু করলে ডলারের মূল্য ব্যাপকভাবে পড়েছিল। সেই সময় থেকে ডলার বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থানে ছিল এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু বর্তমানে ডলারের পতনের পেছনে নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ কাজ করছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি ও আত্মকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির প্রভাব
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন থেকে শুরু হওয়া আগ্রাসী শুল্ক আরোপ, এবং ‘আম ফার্স্ট’ নীতি ডলারের ওপর চাপ তৈরি করেছে। উচ্চ শুল্ক আরোপের কারণে আমদানির খরচ বেড়েছে, আর রপ্তানিকারকরা কিছুটা সুবিধা পেলেও বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা ও সরকারি ঋণের অতিরিক্ত বৃদ্ধি, যা ডলারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতির কারণে শুধু মার্কিন অর্থনীতিই নয়, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশও সংকুচিত হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে মার্কিন সম্পদের বিকল্প খুঁজছেন, যা ডলারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
মুদ্রার দুর্বলতার প্রভাব: বিদেশি বিনিয়োগ থেকে আমদানি-রপ্তানি সবই প্রভাবিত
ডলারের মান কমে যাওয়ার ফলে মার্কিন নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণের ব্যয় বেড়েছে, যার ফলে ভ্রমণ শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি বিনিয়োগও কমে যাচ্ছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য আশঙ্কাজনক।
তবে, ডলারের পতনের কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। মার্কিন রপ্তানিকারকরা এই দুর্বল মুদ্রার সুবিধা পাচ্ছেন, কারণ তাদের পণ্য তুলনামূলক সস্তা হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে। কিন্তু আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় গ্রাহকদের উপর চাপ বাড়ছে। এর ফলে বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা আরও জোরালো হয়েছে।
শেয়ারবাজারের প্রভাব ও বিনিয়োগকারীদের মনোভাব
যদিও শেয়ারবাজার ও বন্ড মার্কেট কিছুটা চাঙা হয়েছে, ডলারের অবমূল্যায়ন একটি বড় উদ্বেগের কারণ। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ স্টিভ ইংল্যান্ডার উল্লেখ করেছেন, “ডলার দুর্বল না শক্তিশালী হওয়া মূল প্রশ্ন নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতির দৃষ্টিতে মার্কিন অবস্থান কেমন, সেটাই প্রকৃত বিষয়।”
ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের সময় ডলার সূচক সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, কিন্তু এরপর থেকে ডলারের মান ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করে। ব্যবসাবান্ধব নীতির বদলে শুল্ক আরোপের অনির্দিষ্টতা আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন।
মার্কিন অর্থনীতির ঋণ ও ঘাটতির সংকট
ডলারের পতনের সঙ্গে যুক্ত অন্যতম বড় কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি। ট্রাম্প প্রশাসন ব্যয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করলেও, সেই অর্থ পুষিয়ে নিতে সরকারের আরো ঋণ নিতে হবে। কিন্তু ঋণগ্রহীতারা ধীরে ধীরে মার্কিন অর্থনীতির ওপর আস্থা হারাচ্ছে, যার ফলে ঋণের চাহিদা কমতে পারে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, মার্কিন ট্রেজারি বন্ড কি আর ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে কাজ করবে? ডলারের এই দুর্বল অবস্থায়, বিনিয়োগকারীরা ‘ডিডলারাইজেশন’ অর্থাৎ ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন বাড়ানোর দিকে ঝুঁকছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের অনেক দেশ এই প্রবণতা ত্বরান্বিত করেছে।
ডিডলারাইজেশন ও বিশ্ব অর্থনীতিতে তার প্রভাব
রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্বের অনেক দেশ বুঝতে পেরেছে, ডলারকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাই তারা ডলারের নির্ভরতা কমিয়ে বিভিন্ন মুদ্রায় ব্যবসায়িক লেনদেন বাড়াচ্ছে। যদিও বিশ্লেষকেরা বলছেন, পুরোপুরি ডিডলারাইজেশন এখনো দূরের কথা, তবে ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ডলারের বৈশ্বিক প্রভাব কমছে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের ভবিষ্যত: সংকট নাকি সুযোগ?
বিশ্বের প্রধান মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থান এখন যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা নতুন নয়, তবে এই পতনের মাত্রা ও পেছনের কারণগুলো গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি, রাজনৈতিক অবস্থা, বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবর্তন, ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চাপ মিলিয়ে ডলারের ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যদি অর্থনৈতিক নীতিতে স্থিরতা আনতে না পারে, ঋণ সংকট ও শুল্ক নীতির পুনর্বিবেচনা না করে, তাহলে ডলারের পতন আরও গভীর হতে পারে। অন্যদিকে, এই পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী নতুন বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সুযোগ তৈরি করতে পারে, যেখানে ইউরো, চীনের ইউয়ান, ও অন্যান্য প্রধান মুদ্রার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে।
১৯৭৩ সালের পর ডলারের সবচেয়ে বড় পতনের এই সময়কে শুধু এক অর্থনৈতিক সংকট হিসেবে দেখা উচিত নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক আর্থিক পরিবর্তনের সূচনা হিসেবেও গণ্য হতে পারে। মুদ্রা পরিবর্তনের এই নতুন অধ্যায়ে বিশ্ব অর্থনীতি আরও বহুমাত্রিক, প্রতিযোগিতামূলক ও জটিল হয়ে উঠবে।
ডলারের পতন বিশ্ববাজারে নতুন শক্তি সমীকরণের সূচনা করবে, যেখানে মার্কিন অর্থনীতি তার ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্ব হারাতে পারে। এ সময় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসবে, যা প্রত্যেক দেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ উভয়ই আনতে বাধ্য।