মণিপুরে গুলিতে কুকি জনগোষ্ঠীর চারজন নিহত

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের চূড়াচাঁদপুর জেলায় গত সোমবার গুলিতে কুকি জনগোষ্ঠীর চারজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, তিনজনের মৃতদেহ একটি গাড়ির ভিতরে পাওয়া গেছে এবং তাদের শরীরে গুলির চিহ্ন স্পষ্ট। আরেকজন নারীর দেহ কিছুটা দূরে পাওয়া গেছে, যিনি কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলে মনে করা হচ্ছে।
নিহতরা কে?
মণিপুর পুলিশের বরাতে জানা গেছে, মৃতদের মধ্যে একজন হলেন থেনখোথাং হাওকিপ (৪৮), যিনি কুকি ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামক বিদ্রোহী সংগঠনের উপপ্রধান ছিলেন। তার সঙ্গে থাকা দুইজন সাধারণ সদস্য সেইখোগিন (৩৫) ও লেঙ্গোহাও (৩৫) গুলিতে নিহত হয়েছেন। চূড়াচাঁদপুর জেলার মাতেজাং, তেসেং ও চেংকোন অঞ্চল থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরেকজন ৭২ বছর বয়সী ফলহিং নামে এক নারী কোয়েট গ্রামের, যিনি এই সংঘর্ষের অংশ নন, তাঁর দেহ মর্গে রাখা হয়েছে।
ঘটনার পটভূমি
মণিপুরের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে প্রায় দুই বছর ধরে মেইতেই সম্প্রদায় এবং কুকি-জো আদিবাসীদের মধ্যে সংঘাত চলছে। এই সংঘাতের তীব্রতা বিশেষত চূড়াচাঁদপুরে বেশি, যেখানে সাম্প্রতিক এই গুলিতে চারজনের মৃত্যু ঘটেছে। পুলিশের অনুমান, এটি কুকি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলাফল।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিবরণ
কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (কেএনএ) দীর্ঘদিন ধরে মণিপুরে সক্রিয়। ২০০৭-০৮ সালে তারা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করে অস্ত্র বিরতি ঘোষণা করেছিল। তবে এই সংগঠনের বিরোধী দল ইউনাইটেড কুকি ন্যাশনাল আর্মি (ইউ-কেএনএ) শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়নি। ইউ-কেএনএ দাবি করে, কেএনএ তাদের সদস্যদের উপর নানা রকম হেনস্থা ও হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। থেনখোথাং হাওকিপের নেতৃত্বে কেএনএ গত কয়েক বছরে ইউ-কেএনএর ৩০ জনের বেশি সদস্যকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বক্তব্য
ইউ-কেএনএ এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে যে, সোমবারের হামলা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী করা হয়েছে এবং তারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়বদ্ধ। অন্যদিকে মণিপুর পুলিশ ইতিমধ্যে দক্ষিণ মণিপুরের চূড়াচাঁদপুর এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে। পুলিশ আশঙ্কা করছে, এই দ্বন্দ্ব আরও বাড়তে পারে এবং এর ফলে এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তারা নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও মানবিক সংকট
গত দুই বছরে মণিপুরে সংঘর্ষে প্রায় ২৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। একই সঙ্গে ৬০,০০০ এর বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। চূড়াচাঁদপুর জেলার মতো স্পর্শকাতর এলাকায় সহিংসতা ছড়ানোর আশঙ্কা থাকায় পুলিশ ও রাজ্য প্রশাসন নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠোর করছে।
মণিপুর পরিস্থিতির জটিলতা ও ভবিষ্যৎ চিন্তা
মণিপুরে বহু উপজাতীয় গোষ্ঠীর বিদ্রোহী সংগঠন সক্রিয়। তাদের মধ্যে সংঘাত ও স্বার্থবিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। বিশেষত কুকি এবং মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই ও জমি দখল নিয়ে সমস্যাগুলো গভীর। সাম্প্রতিক ঘটনার ফলে রাজ্যের শান্তি পরিস্থিতি বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে রাজ্য সরকার।
বিশেষজ্ঞ মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মণিপুরের মতো জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার আন্তঃগোষ্ঠীয় সংলাপ ও সমঝোতা। শুধুমাত্র বাহিনী দিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। আধিকারিকদের উচিত স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বসে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যাতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব কমানো যায়।
সার্বিক পরিস্থিতি: মণিপুরের উত্তপ্ত আবহাওয়া ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ
- মণিপুরের চূড়াচাঁদপুর জেলায় কুকি ও মেইতেই সম্প্রদায়ের সংঘাত দীর্ঘদিনের।
- বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সাম্প্রতিক গুলির পেছনে মূল কারণ।
- চারজন নিহত, যার মধ্যে কুকি ন্যাশনাল আর্মির উচ্চপদস্থ সদস্যও রয়েছেন।
- পুলিশ এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি চালাচ্ছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
- গত দুই বছরে সহিংসতায় ২৫০+ জন নিহত, ৬০,০০০ এর বেশি গৃহহীন।
- স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য শান্তি প্রক্রিয়া চালানো এখন অত্যন্ত জরুরি।
মণিপুরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। সিংগনালবিডি ডটকম এই সংঘর্ষের সব দিক গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করে আপডেট নিয়ে আসবে।