বিশ্ব

কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতির মধ্যেই বিস্ফোরণ, উত্তেজনা প্রশমনে সৌদি-ইরানের সক্রিয়তা

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শ্রীনগরে বিস্ফোরণের শব্দে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে দুই দেশ ফের একে অপরকে দোষারোপ করছে। এই অবস্থায় মধ্যস্থতার উদ্যোগে নেমেছে কিছু ‘অপ্রত্যাশিত’ খেলোয়াড়—বিশেষ করে সৌদি আরব, কাতার ও ইরান।

১১ মে শনিবার রাতে নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি দাবি করেন, পাকিস্তান একাধিকবার যুদ্ধবিরতির সমঝোতা লঙ্ঘন করেছে এবং ভারত এর যথাযথ জবাব দিচ্ছে। পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় জানায়, তারাই বরং প্রতিশ্রুতিতে অটল এবং ভারতের পক্ষ থেকেই যুদ্ধবিরতির শর্ত ভাঙা হয়েছে।

তবে এই দ্বন্দ্বের মাঝেই আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্রিয় হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি ইসলামাবাদ থেকে সরাসরি দিল্লিতে গিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। পাশাপাশি সৌদি আরবও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেছে। কারণ, উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ২৬ লাখ ভারতীয় এবং প্রায় সমসংখ্যক পাকিস্তানি শ্রমিক কাজ করছেন। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে সৌদি আরব চায় না দুই দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হোক।

এদিকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণার সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, দুই পক্ষ অবিলম্বে অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়েছে এবং এই চুক্তি বাস্তবায়নে ৩০টিরও বেশি দেশ সহযোগিতা করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দুই দেশের নেতাদের শান্তির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, কাশ্মীরসহ বিবদমান বিষয়ে নিরপেক্ষ আলোচনার পথ তৈরি হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—এই শান্তি কি টেকসই হবে? শ্রীনগরজুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, “সবে হওয়া যুদ্ধবিরতি কি তবে ছাইয়ে পরিণত হলো?”

কাশ্মীর হামলার পেছনের সূত্র

সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক পর্যটকবহরে ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পরই পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে গড়ায়। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং পাল্টা সামরিক হামলা চালায়। পাকিস্তান হামলার দায় অস্বীকার করে স্বাধীন তদন্তের দাবি জানায়। পাল্টাপাল্টি হামলায় দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকট হয়ে ওঠে।

এ সময় পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির সেনাদের উদ্দেশে বলেন, ভারতের যেকোনো আগ্রাসনের জবাব হবে “তৎক্ষণাৎ, কঠিন এবং আরও শক্তিশালী।” বিশ্লেষকরা বলছেন, মুনির একজন জাতীয়তাবাদী ও কঠোর অবস্থানের পক্ষপাতী, যার কারণে এই উত্তেজনা আরও জটিল রূপ নিচ্ছে।

মোদির রাজনৈতিক বাস্তবতা ও নির্বাচনী কৌশল

পাকিস্তানের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরীর মতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক চাপও এই সংকটের পেছনে একটি বড় কারণ। তিনি বলেন, “ভোট কমে যাওয়ায় মোদি কাশ্মীরের সীমানা বদলে নিজের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে চাইছেন।” এর আগে মোদি সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে বিতর্ক তৈরি করেছিল।

আন্তর্জাতিক কৌশলগত পালাবদল

এবারের সংঘাত প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এমনকি ইরানও সক্রিয়ভাবে মধ্যস্থতার ভূমিকা নিচ্ছে। আগে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো ধর্মীয় সংহতির ভিত্তিতে পাকিস্তানকেই সমর্থন করত। কিন্তু এখন তারা নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পাকিস্তানকে ‘শান্ত থাকার’ আহ্বান জানিয়েছে এবং ভারতের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছে বলে ভারতীয় সূত্রের দাবি।

অন্যদিকে চীনও এই উত্তেজনায় নিঃসন্দেহে একটি বড় পক্ষ। পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান বহরে রয়েছে চীনের তৈরি জে-১০সি এবং পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র। ভারতের সঙ্গে সীমান্তসংলগ্ন কাশ্মীর অঞ্চলেও চীনের অংশ রয়েছে, যেটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষক ফাওয়াদ চৌধুরীর মতে, “কাশ্মীর সীমান্ত পরিবর্তনে ভারতের কোনো উদ্যোগ থাকলে চীন তা কখনোই মানবে না।”

পুরোনো চুক্তি বাতিল, নতুন শঙ্কা

সম্প্রতি ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত রাখার ঘোষণা এবং পাকিস্তানের জবাবে ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি বাতিল করা—এই দুই পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। শিমলা চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মীর সীমান্তের ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ ছিল দুই দেশের মধ্যে একটি অস্থায়ী সীমা। এই লাইন এখন শুধু অস্ত্রবিরতির রেখা, যেটি যেকোনো পক্ষ সামরিকভাবে বদলে দিতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সমাজের কূটনৈতিক চাপ এবং মধ্যস্থতা হয়তো সাময়িক স্বস্তি দিচ্ছে, তবে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে হলে চাই দীর্ঘমেয়াদি, আন্তরিক এবং সতর্ক উদ্যোগ। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা এখন আর কেবল দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক ইস্যু নয়—এটি আন্তর্জাতিক কৌশলগত ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button