অর্থনীতি

জুনের মধ্যে আইএমএফের ১৩০ কোটি ডলার পাওয়ার আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা জোরদারের লক্ষ্যে বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা পাওয়ার প্রত্যাশা দ্রুত বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এর কাছ থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তিতে ১৩০ কোটি ডলার পাওয়ার আশা করা হচ্ছে আসন্ন জুন মাসেই

আজ ১৪ মে (বুধবার) দুপুরে পাঠানো এক সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একত্রে ছাড় হচ্ছে

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যেই আইএমএফের চতুর্থ পর্যালোচনার কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। উল্লেখ্য, তৃতীয় পর্যালোচনার সময়েই সিদ্ধান্ত হয়, চতুর্থ মিশনের আওতায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা বিনিময় হার এবং অন্যান্য কাঠামোগত সংস্কার বিষয়ে আলোচনা ও অগ্রগতির পর চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একত্রে ছাড় করা হবে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ঢাকায় আইএমএফের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর একই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভায় আলোচনা অব্যাহত ছিল।

পর্যালোচনার ভিত্তিতে ‘স্টাফ লেভেল অ্যাগ্রিমেন্ট’ সম্পন্ন হওয়ায় বাংলাদেশ এখন আশাবাদী, জুনের মধ্যেই নির্ধারিত ১৩০ কোটি ডলার ছাড় করা হবে

আরও ২০০ কোটি ডলার সহায়তা আসছে অন্যান্য উৎস থেকে

শুধু আইএমএফ নয়, অর্থ মন্ত্রণালয় আশা করছে জুনের মধ্যেই বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (AIIB), জাপান সরকার এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (OFID) থেকে আরও ২০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়া যাবে।

এই অর্থ সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহায়তা দেশের মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ডলার সংকট দেখা দিয়েছে, যা আমদানি ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। সেই সংকট উত্তরণেই এই সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

রিজার্ভ শক্তিশালী করতেই বাজেট সহায়তা

বর্তমানে বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে টাকার মান ১ ডলার সমান ১১৬ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে এবং মূল্যস্ফীতিও উর্ধ্বগামী।

এই প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া গেলে দেশের রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি পরিচালনায় সহায়তা দেবে এবং বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াতে সহায়ক হবে।

সরকারি সংস্কার কর্মসূচি নিজেদের পরিকল্পনায়

অনেকেই মনে করেন উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা পেতে সরকার অনেক সময় কঠিন শর্ত মেনে নেয়। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য ভিন্ন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যেসব সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, তা বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব বিবেচনায় পরিকল্পিত এবং জাতীয় স্বার্থে গৃহীত। আইএমএফসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরা শুধু কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করছে না।

সংস্কারগুলো মূলত রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিতকরণ, বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন বাড়ানোর দিকে কেন্দ্রিত।

আইএমএফ চুক্তির পটভূমি

২০২২ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক চাপে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা চেয়ে আবেদন করে। এতে তিন ধাপে ঋণ অনুমোদন হয়:

  • প্রথম কিস্তি: জানুয়ারি ২০২৩ (৪৭ কোটি ডলার)
  • দ্বিতীয় কিস্তি: ডিসেম্বর ২০২৩
  • তৃতীয় কিস্তি: মার্চ ২০২৪
  • চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি: জুন ২০২৫ (প্রত্যাশিত)

এই ঋণের বিপরীতে সরকারকে বিভিন্ন নৈতিক ও কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

অর্থনীতিবিদদের মতে, আইএমএফের সহায়তা যেমন তাৎক্ষণিক বৈদেশিক লেনদেন ব্যবস্থায় স্বস্তি আনে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে না পারলে তা সমস্যার কারণও হয়ে উঠতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন:

“আইএমএফ শুধু অর্থ দেয় না, তারা দেখতে চায় অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে কিনা। বাংলাদেশ সরকার সেই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে সফল হলে, শুধু এই কিস্তিই নয়, ভবিষ্যতেও আরও বড় সহায়তা পাওয়া সম্ভব।”

অর্থনীতির চাপ মোকাবিলায় আইএমএফের ১৩০ কোটি ডলার ও অন্যান্য উৎস থেকে ২০০ কোটি ডলার সহায়তা বাংলাদেশের জন্য এক বড় সুযোগ।
এই অর্থ শুধু রিজার্ভ নয়, সরকারি ব্যয়, উন্নয়ন খাত ও বৈদেশিক বাণিজ্যেও ভারসাম্য আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তবে এই সহায়তা পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হলে প্রতিশ্রুত সংস্কারগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। সময়মতো অর্থ ছাড় ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশ আবারও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে ফিরতে পারবে—এমনটাই আশা অর্থ বিশেষজ্ঞদের।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button