আঞ্চলিক

ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নে গিয়েছিলেন জাপানে , খাবারের অভাবে নির্মম মৃত্যু!

 অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে জাপানে পাড়ি জমিয়েছিলেন মোহাম্মদ আফরিজি। কিন্তু চরম দারিদ্র্য ও নিঃসঙ্গতার নির্মম বাস্তবতায় তার জীবন থেমে গেল একটি ভাড়া বাসায়। দীর্ঘদিন না খেয়ে ও মানসিক অবসাদে ডুবে তিনি বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।

স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ যাত্রা, ফিরলেন কফিনে

২৬ বছর বয়সী মোহাম্মদ আফরিজি বিন আপন জাপানে গিয়েছিলেন উচ্চতর পড়াশোনা ও একটি সুন্দর ক্যারিয়ারের আশায়। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার হৃদয়ে। কিন্তু উন্নত দেশ জাপানের ব্যস্ত জীবনের ভিড়ে তিনি হারিয়ে গেলেন নিঃসঙ্গতা, দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার সঙ্গে এক অসম লড়াইয়ে। আফরিজির মৃতদেহ উদ্ধার হয় একটি ছোট্ট ভাড়া বাসা থেকে, যেখানে তিনি একা ও অসহায়ভাবে কাটাচ্ছিলেন জীবনের শেষ দিনগুলো।

অর্থনৈতিক সংকট থেকে শুরু, সব বন্ধ হয়ে যায়

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, জাপানে থাকাকালীন সময়ে আফরিজির টিউশন ফি বকেয়া পড়ে যায়। এরপর একে একে বন্ধ হয়ে যায় তার সমস্ত মৌলিক সুবিধা — বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস এমনকি মোবাইল সংযোগও। নিঃসঙ্গ এই তরুণ দিনের পর দিন কাটিয়েছেন না খেয়ে, এমনকি এক ফোঁটা পানিও জোটেনি শেষ দিকে।

তিনি পড়ে যান চরম আর্থিক ও মানসিক সংকটে। বন্ধ হয়ে যায় বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ। দিন শেষে, নিজের বাসাতেই কার্যত বন্দি হয়ে পড়েন তিনি।

বিষণ্নতা ও অবসাদে মৃত্যু

পারিবারিক ও বন্ধুদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে আফরিজি চরম বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। তিনি প্রায় কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না। প্রতিবেশীরা জানান, টানা ১৫ দিন তাকে বাসা থেকে বের হতে দেখা যায়নি।

এক পর্যায়ে তার বন্ধুরা খাবার পৌঁছে দিলেও সেগুলো পড়ে থাকত ঠিক আগের জায়গাতেই। কারণ, তিনি ভেতর থেকে দরজা খুলে খাবার নেয়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলেন।

শেষবার তাকে দেখা যায় রান্নাঘরের ছোট জানালার ফাঁক দিয়ে, যেখানে তিনি মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে বলেছিলেন — “চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”

দেরি হয়ে যায় সাহায্য

জাপানের আইনি কাঠামো অনুযায়ী, অনুমতি ছাড়া কারো বাসার দরজা ভাঙা নিষিদ্ধ। ফলে তার বন্ধুরা ও পরিচিতজনেরা সিদ্ধান্ত নেন আগামী রবিবার পুলিশ ও জরুরি সেবা নিয়ে এসে দরজা খোলা হবে। কিন্তু সেই অপেক্ষার আগেই মৃত্যুকে আপন করে নেন আফরিজি।

তার নিথর দেহ উদ্ধার করা হয় যখন, তখন শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে ওজন ১০ কেজিও ছিল না। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত্যু সময় তার দেহ পুরোপুরি শক্ত হয়ে গিয়েছিল — ক্ষুধা ও অবসাদের চূড়ান্ত রূপ।

প্রবাসজীবনের অন্ধকার দিক

এ ঘটনা নতুন কিছু নয় — উন্নত দেশে গিয়ে অনেক তরুণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ভাষাগত সমস্যা, আর্থিক সংকট, একাকীত্ব এবং সংস্কৃতির পার্থক্য অনেক সময় তরুণদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত সাপোর্ট সিস্টেম না থাকলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতেই থাকবে। বাংলাদেশি কমিউনিটির পক্ষ থেকে একজন মন্তব্য করেন, “আমরা সবাই তার পাশে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আইন, দূরত্ব ও সময় — সব মিলে আমরা ব্যর্থ হলাম।”

আফরিজির গল্পে প্রশ্ন উঠে: কে দায়ী?

এই মৃত্যু শুধু একটি মর্মান্তিক ঘটনা নয়, বরং এটি প্রবাসে থাকা হাজারো তরুণের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। কে দায়ী এই মৃত্যুর জন্য? পরিবার? বন্ধু? সমাজ? নাকি আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র?

বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা ও জরুরি সহায়তা ফান্ড থাকা উচিত। একইসঙ্গে, কমিউনিটি পর্যায়ে প্রবাসীদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও মানবিক সংযোগ আরও বাড়াতে হবে।

কী হতে পারে সমাধান?

আফরিজির মৃত্যুর ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে — শুধু স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিলেই জীবন সহজ হয় না। প্রবাসজীবনের চ্যালেঞ্জগুলো যদি উপেক্ষা করা হয়, তবে তার পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ।

বাংলাদেশ সরকার ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উচিত, এমন ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি সুরক্ষিত কাঠামো গড়ে তোলা।

তবে প্রশ্ন থেকে যায় — পরবর্তী আফরিজিকে আমরা বাঁচাতে পারব তো?

এম আর এম – ০১২৯, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button