শিক্ষাজীবনে কোটা নেননি শারীরিক প্রতিবন্ধী উল্লাস, বিসিএসে পেলেন প্রশাসন ক্যাডার

“যেখানে ইচ্ছা, সেখানে পথ”—এই পুরনো কথাটিই যেন আবারও সত্য প্রমাণ করলেন শরীয়তপুরের তরুণ উল্লাস পাল। জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জীবনের একের পর এক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে উল্লাস পেয়েছেন ৪৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে চূড়ান্ত সুপারিশ। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে—নিজে শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও কখনও কোটার আশ্রয় নেননি তিনি।
জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, কিন্তু মানসিক দৃঢ়তায় অটল ছিলেন উল্লাস
ভেদরগঞ্জ উপজেলার কার্তিকপুর পালপাড়া গ্রামের মৃৎশিল্পী উত্তম কুমার পাল এবং গৃহিণী আন্না রানী পালের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন উল্লাস পাল। জন্মের সময় থেকেই বাঁকা হাত-পা নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেন তিনি। ছোটবেলায় যখন অন্য শিশুরা হাঁটতে শেখে, তখন উল্লাসকে চলতে হতো পরিবারের সাহায্যে। পরে ভারতে নিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে কিছুটা চলাফেরা করার উপযোগী হলেও, স্বাভাবিক হাঁটা তার ভাগ্যে জোটেনি কখনও।
শিক্ষাজীবনে কখনো নেননি প্রতিবন্ধী কোটা
প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বর্ষায় যখন কাদামাটি মাড়িয়ে স্কুলে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠত, তখন বাবা কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন তাকে। এরপর মাধ্যমিকে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় এবং উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকার নর্দান কলেজ বাংলাদেশ থেকে জিপিএ-৫ অর্জন করেন উল্লাস।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ও সুযোগ ছিল শারীরিক প্রতিবন্ধী কোটার। কিন্তু উল্লাস সাফ জানিয়ে দেন—”আমি প্রতিযোগিতা করতে চাই সাধারণদের সঙ্গেই। কোটা নয়, আমি আত্মবিশ্বাসে বিশ্বাস করি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় ‘গ’ ইউনিটে মেধাতালিকায় ৪৬৩তম হয়ে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন।
একবার নয়, একাধিক বিসিএসে অংশগ্রহণ
উল্লাস পালের বিসিএস যাত্রা শুরু হয়েছিল ৪০তম বিসিএস থেকে। তবে সেইবার পাস করেও পাননি কাঙ্ক্ষিত পদ। ৪১তম বিসিএসে তিনি সুপারিশ পান ‘জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর’ পদে। এরপর ৪৩তম বিসিএসে তিনি শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন এবং বর্তমানে নড়িয়া সরকারি কলেজে কর্মরত।
তবে তার হৃদয়ের গহীনে ছিল একটাই স্বপ্ন—প্রশাসন ক্যাডারে কাজ করার। অবশেষে ৪৪তম বিসিএসে সেই স্বপ্নই সত্যি হলো।
মৌখিক পরীক্ষায় নেতিবাচক প্রশ্ন, তবু দমেননি
৪০তম বিসিএসে এক পরীক্ষক তাকে প্রশ্ন করেন, “আপনি তো হাঁটতে পারেন না, প্রশাসনে তো অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। পারবেন তো?” এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনোবল হারাননি উল্লাস। তিনি মনে করেন, সেই নেতিবাচক মনোভাবই হয়তো তাঁকে প্রশাসন ক্যাডারে ঠেকিয়ে দেয়। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বারবার চেষ্টা করে অবশেষে নিজের প্রাপ্যটুকু আদায় করে নিয়েছেন।
মেধা, অধ্যবসায় আর পরিবার—এই ছিল তার মূল শক্তি
উল্লাস বলেন, “আমি বরাবরই নিজের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করেছি। আমি নিজেকে সুস্থই মনে করি। শারীরিকভাবে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকলেও মানসিকভাবে আমি ছিলাম এবং আছি একদম শক্ত। আমার পরিবার সবসময় পাশে ছিল, তাই এগিয়ে যেতে পেরেছি।”
তার মা-বাবার অক্লান্ত চেষ্টা, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আন্তরিকতা এবং নিজস্ব অধ্যবসায়ের ফলে তিনি একের পর এক সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন।
পালপাড়ার গর্ব উল্লাস, গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে
পালপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা উল্লাসের এই অর্জনে আনন্দে আত্মহারা। গ্রামের এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “উল্লাস আমাদের গর্ব। সে প্রমাণ করেছে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কোনো বাধা নয়, ইচ্ছাশক্তিই আসল শক্তি।”
কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, “উল্লাস আমার ছাত্র ছিল। তার এই সাফল্যে আমি গর্বিত। সে আরও বড় হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”
নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা
উল্লাস মনে করেন, বিসিএস কিংবা জীবনের যেকোনো বড় লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধৈর্য, পরিশ্রম ও সময়ের সঠিক ব্যবহার অপরিহার্য। নতুন প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “চটজলদি কিছু হয় না। সফল হতে হলে লম্বা সময় ধরে প্রস্তুতি নিতে হবে। আমি বলব, অন্তত পাঁচ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুতি নিন।”
প্রতিকূলতাকে জয় করার নামই উল্লাস
উল্লাস পাল শুধু একজন বিসিএস ক্যাডার নন, তিনি হয়ে উঠেছেন হাজারো তরুণ-তরুণীর জন্য অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন—কোটা না নিয়েও একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তার স্বপ্নপূরণ করতে পারেন, যদি থাকে মেধা, আত্মবিশ্বাস এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি।
এম আর এম – ০১২৬, Signalbd.com