হায়দরাবাদে ভয়াবহ রাসায়নিক কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত বেড়ে ৩২, আহত ৩৫+

ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদ থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে সঙ্গারেড্ডি জেলার পশমাইলারাম শিল্পাঞ্চলে সিগাচি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ফার্মাসিউটিক্যাল ও রাসায়নিক কারখানায় ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ জনে, আহত হয়েছেন অন্তত ৩৫ জন, যাদের মধ্যে ১১ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। এছাড়াও এখনও ২৭ জন কর্মী নিখোঁজ রয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিস্ফোরণের ঘটনা ও প্রাথমিক তথ্য
গত সোমবার স্থানীয় সময় সকালেই সিগাচি ইন্ডাস্ট্রিজের রাসায়নিক উৎপাদন ইউনিটে একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের আওয়াজে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের পর কালো ধোঁয়া আকাশে উঠতে দেখা যায়। শুনতে পাওয়া যায় একাকার উচ্চ শব্দ, যা পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা গেছে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারকারী দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে।
বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে, একটি রাসায়নিক রিঅ্যাক্টর অথবা এয়ার ড্রায়ার ব্যবস্থায় ত্রুটি থেকে আগুন লাগতে পারে। তবে তদন্ত এখনও চলমান। কারখানাটি প্রায় ৪০-৪৫ বছর পুরোনো এবং মাইক্রোক্রিস্টালাইন সেলুলোজ নামে রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন করতো।
হতাহতের বিশদ বিবরণ ও উদ্ধারকাজ
ঘটনার সময় কারখানার ভিতরে মোট ১০৮ জন কর্মী ছিলেন। বিস্ফোরণ ও আগুনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, অনেক শ্রমিক আকাশে ছিটকে পড়ে যান। আহতদের মধ্যে ১১ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন, যাদের চিকিৎসা চলছে বিভিন্ন হাসপাতালে। আহতদের মাঝে অনেকেই বিহার, উত্তর প্রদেশ ও ওড়িশার পরিযায়ী শ্রমিক।
রাজ্যের দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী (এসডিআরএফ), হায়দরাবাদ দুর্যোগ মোকাবিলা ও সম্পদ সুরক্ষা সংস্থা (এইচওয়াইআরএএ) এবং পুলিশ এখনো উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৫টি অগ্নিনির্বাপক ইঞ্জিন ব্যবহার করেছে।
প্রশাসনের পদক্ষেপ ও তদন্ত কমিটি গঠন
হায়দরাবাদের মুখ্যমন্ত্রী এ. রেভন্থ রেড্ডি আজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবেন এবং আহতদের সঙ্গে কথা বলবেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী দামোদর রাজা নারসিমা ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছেন এবং জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি।
শ্রমমন্ত্রী জি. বিবেক জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, রিঅ্যাক্টর থেকে নয়, বরং এয়ার ড্রায়ার ব্যবস্থায় কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা যান্ত্রিক সমস্যা থেকেই আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটেছে।
তেলেঙ্গানা সরকার একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিতে রয়েছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষ সচিব, শ্রম ও স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রধান সচিবগণ এবং ফায়ার সার্ভিসের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল। এই কমিটি দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করবে এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রদান করবে।
তেলেঙ্গানার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্যোগ
এই বিস্ফোরণকে তেলেঙ্গানার শিল্প ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এর প্রভাব শুধু নিহত ও আহতের সংখ্যা বাড়ানো নয়, বরং অঞ্চলের শিল্প নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রের স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের নানা শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তার মান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ প্রয়োজন। কারখানাগুলোর নিয়মিত পরিদর্শন, আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার এবং কর্মীদের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণের অভাব এই ধরনের দুর্ঘটনার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সাম্প্রতিক সময়ের রাসায়নিক কারখানার দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত
ভারতে পূর্বেও রাসায়নিক কারখানায় এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে গুজরাটের ভাজা এলাকার একটি রাসায়নিক কারখানায় আগুন লেগে বহু শ্রমিক নিহত হয়। সে কারণে শিল্প নিরাপত্তা আইন আরও কঠোর করার দাবি উঠেছে।
এছাড়া, করোনা পরবর্তী সময়ে শ্রমিক সংকট এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ঘাটতি অনেক কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়িয়েছে। সরকারের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে আরও স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা জরুরি।
ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় সরকারের দৃষ্টি
তেলেঙ্গানা সরকার দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। জরুরি অবস্থা মোকাবিলা ব্যবস্থার উন্নয়ন, উদ্ধার কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং শ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ চলছে।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই দুর্ঘটনার কারণে রাজ্যের সকল শিল্প কারখানায় বিশেষ নিরাপত্তা পরিদর্শন চালানো হবে। এ ছাড়াও শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্য বিমা ও জরুরি চিকিৎসা সুবিধা উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
হায়দরাবাদের এই রাসায়নিক কারখানার বিস্ফোরণ শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি শিল্প নিরাপত্তার দিকে সবার নজর আকর্ষণ করেছে। নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে, সরকারের উচিত দ্রুত তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং ভবিষ্যতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা।
শ্রমিকদের জীবন রক্ষা, শিল্প নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের শিল্প ক্ষেত্রকে নিরাপদ এবং প্রগতিশীল করে তোলা এখন সময়ের দাবি।
কী কী শিখতে পারি এই দুর্ঘটনা থেকে?
- শিল্পক্ষেত্রে নিয়মিত নিরাপত্তা পরিদর্শন ও আধুনিক সরঞ্জামের ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
- শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ নিয়মিত দেওয়া প্রয়োজন।
- দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী ও উদ্ধার টিমের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা জরুরি।
- কারখানার পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।
- সরকারের উচিত শিল্প নিরাপত্তার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ।