বানিজ্য

যশোরে আলুর দরপতন, কেজিতে ১০ টাকা লোকসান কৃষকের

যশোরে আলুর দাম পড়ে গেছে তলানিতে, কৃষকরা লোকসানে দিশেহারা

যশোরের কৃষকদের মুখে এবার হাসি নেই। কারণ, এ বছর আলু উৎপাদন করে তারা পড়েছেন চরম লোকসানে। প্রতি কেজি আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণের খরচ পড়েছে যেখানে ২৪ টাকা, সেখানে হিমাগার থেকে আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৫ থেকে ১৬ টাকায়। ফলে কেজি প্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা লোকসান গুনছেন কৃষকেরা।

যশোরে আলু আবাদ ও উৎপাদন পরিসংখ্যান

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মৌসুমে যশোর জেলায় ১ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। এই জমি থেকে উৎপাদিত আলুর পরিমাণ ৩৬ হাজার ৩৪৮ মেট্রিক টন। জেলার ১১টি হিমাগারে মোট ৪০ হাজার ৪৯৬ মেট্রিক টন খাবার আলু ও ৩ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন বীজ আলু সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু দাম না থাকায় হিমাগার থেকে আলু বের হচ্ছে না। গত পাঁচ মাসে মাত্র ১০ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন আলু হিমাগার থেকে বের হয়েছে। এখনও প্রায় ৩০ হাজার টনের বেশি আলু মজুত রয়েছে।

উৎপাদন খরচ ও লোকসান বিশ্লেষণ

নোঙরপুর গ্রামের কৃষক বদরুল আলম জানান, “এই বছর ৩৩ শতকের ৭ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। প্রতি বিঘায় খরচ পড়েছে ৩৫ হাজার টাকার মতো। হিমাগারে প্রতি কেজি আলু রাখার খরচ পড়েছে ২৪ টাকা। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে ১৫ টাকায়।” অর্থাৎ বস্তায় বস্তায় তারা গুনছেন লোকসান। একেকটি বস্তায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়ছেন তারা।

হিমাগারগুলোতে শ্রমিক, পরিবহন, বস্তা ও ভাড়ার খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণের খরচ দাঁড়ায় ২৪ টাকা। অথচ পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১৫ থেকে ১৬ টাকায়। হিমাগার কর্তৃপক্ষও বলছেন, কেজিতে ৯ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনছেন কৃষকেরা।

বাজারে আলুর দরপতনের কারণ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েকটি কারণে আলুর বাজারে দরপতন ঘটেছে:

  1. অতিরিক্ত উৎপাদন: মৌসুমের শুরুতে আলুর ভালো ফলন হওয়ায় প্রচুর পরিমাণ আলু বাজারে আসে।
  2. রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতা: মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আলু রপ্তানির প্রচেষ্টা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে রপ্তানি হয়নি।
  3. অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও জলাবদ্ধতা: যার ফলে অন্যান্য শাক-সবজির উৎপাদন কম হলেও বাজারে আলুর ওপর চাহিদা তেমন বাড়েনি।
  4. পাইকারি বাজারের অসততা ও সিন্ডিকেট: ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না।

ভবিষ্যৎ সংকটের আশঙ্কা

কৃষকরা বলছেন, এভাবে লোকসান গুনতে হলে আগামী মৌসুমে অনেকেই আর আলু চাষে আগ্রহী হবেন না। এর প্রভাব পড়বে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও। কারণ, দেশে আলুর বিকল্প হিসেবে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন নিশ্চিত করা কঠিন হবে।

বাঘারপাড়ার গাইটঘাট এলাকার সরদার রোকেয়া কোল্ডস্টোরেজে সংরক্ষিত ৭,৪৩১ মেট্রিক টন আলুর মধ্যে গত পাঁচ মাসে মাত্র ৫৪৫ মেট্রিক টন আলু হিমাগার থেকে বের করা হয়েছে। হিমাগারটির সিনিয়র সুপারভাইজার বলেন, “কৃষকরা আলু বিক্রি করতে পারছেন না। কেজিতে ৯-১০ টাকা পর্যন্ত লোকসান হওয়ায় তারা আলু বের করছেন না।”

কৃষি কর্মকর্তাদের আশ্বাস

যশোর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ জেলা কৃষি কর্মকর্তা কিশোর কুমার সাহা বলেন, “বর্তমানে কৃষকরা কিছুটা লোকসানে থাকলেও আগামী এক মাসের মধ্যে আলুর দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, রপ্তানির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এবং অতিবৃষ্টির কারণে শাক-সবজির উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে আলুর চাহিদা বাড়তে পারে।”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, “যশোরের জমি নিচু হলেও এখানকার আলুর উৎপাদন ভালো হয়েছে। তবে বাজার ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণে কৃষকরা লোকসান গুনছেন।”

কৃষকদের দাবী: সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন

লোকসানের কারণে আলু চাষিরা বর্তমানে হতাশ ও নিরাশ হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন, সংকট মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যেমন:

  • সহজ শর্তে কৃষি ঋণ মওকুফ।
  • সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে আলু ক্রয় করা।
  • আলু রপ্তানির জন্য সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি।
  • কৃষি উপকরণের দাম কমিয়ে দেওয়া।
  • হিমাগার ভাড়া কমানোর উদ্যোগ নেওয়া।

আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির সম্ভাবনা

বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের আলুর ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আলুর চাহিদা রয়েছে। তবে মানসম্মত প্যাকেজিং, দ্রুততর শিপমেন্ট ও আমদানি অনুমোদনের বিষয়গুলোতে জোর দিতে হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ মেট্রিক টন আলু রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এখনও পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২৫ হাজার মেট্রিক টন। রপ্তানিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পরিবহনে বিলম্ব, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামের অভাব এই লক্ষ্য পূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

সংকট সমাধানে করণীয়

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, বর্তমান সংকট নিরসনে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:

  1. সরকারিভাবে আলু কেনার ব্যবস্থা করা।
  2. আলু রপ্তানির আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দ্রুত কাটিয়ে উঠা।
  3. কৃষকদের জন্য ভর্তুকি ও সহজ ঋণ প্রদান।
  4. আলু সংরক্ষণের হিমাগার ভাড়া কমানো।
  5. আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মূল্য সংযোজনের সুযোগ সৃষ্টি।
  6. আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্যাকেজিং ও এক্সপোর্ট কোয়ালিটি নিশ্চিত করা।

যশোরের আলু চাষিরা আজ দিশেহারা। উৎপাদন খরচের তুলনায় দাম না পাওয়ায় তারা মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়েছেন। যদি সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নেয়, তাহলে আগামী মৌসুমে আলু চাষে অনাগ্রহ দেখা দেবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

এখনই সময়—কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর। সংকট নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপ নিলে কৃষকদের মুখে আবারো হাসি ফোটানো সম্ভব।

MAH – 12152 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button