চট্টগ্রামের আনোয়ারার বিশাল শিল্প এলাকায় আবারও ধোঁয়া উঠছে চিমনি থেকে। দীর্ঘ সাত মাস বন্ধ থাকার পর রাষ্ট্রায়ত্ত চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) অবশেষে ইউরিয়া সার উৎপাদন শুরু করেছে।
শনিবার (১ নভেম্বর) রাত থেকে কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় বলে জানিয়েছেন সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিজানুর রহমান।
দীর্ঘ সাত মাসের অচলাবস্থা শেষে নতুন শুরু
চলতি বছরের ১১ এপ্রিল হঠাৎ করে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় কোরিয়ান ইপিজেড গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। এর ফলে দেশের অন্যতম বৃহৎ সার কারখানা সিইউএফএলের উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
প্রায় সাত মাসের বন্ধ অবস্থা শেষে গত ১৯ অক্টোবর থেকে গ্যাস সরবরাহ পুনরায় চালু হয়। তবে উৎপাদন শুরু করতে কারখানাকে ধাপে ধাপে ‘স্টার্টআপ’, ‘অ্যামোনিয়া উৎপাদন’ ও ‘ইউরিয়া প্রক্রিয়া’ সম্পন্ন করতে হয়। অবশেষে ১ নভেম্বর থেকে পূর্ণমাত্রায় ইউরিয়া সার উৎপাদন শুরু হয়।
সিইউএফএলের ইতিহাস ও গুরুত্ব
১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় সিইউএফএল। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি।
প্রতিষ্ঠার সময় কারখানার দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ছিল প্রায় ১,৭০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার এবং ৮০০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়া। বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্য ছিল প্রায় ৫ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া।
বর্তমানে পুরনো যন্ত্রপাতি ও দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থার কারণে উৎপাদন সক্ষমতা কমে দাঁড়িয়েছে দৈনিক ১,১০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া ও ৩ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন অ্যামোনিয়া।
কারখানা বন্ধের কারণ: গ্যাস সংকট ও যান্ত্রিক ত্রুটি
গত দুই বছরে একাধিকবার সিইউএফএলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কখনো যান্ত্রিক সমস্যা, কখনোবা গ্যাসের তীব্র সংকটে থেমে যায় উৎপাদন লাইন।
২০২৪ সালে পুরো বছরে কারখানাটি মাত্র পাঁচ দিন চালু ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বন্ধ হওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতে অল্প সময়ের জন্য চালু হয়, কিন্তু ৭ এপ্রিল আবারও গ্যাস সংকটে স্থবির হয়ে পড়ে পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা।
এমন দীর্ঘ অচলাবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একদিকে উৎপাদন বন্ধ, অন্যদিকে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন চালিয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে সরকারি এই কারখানার ওপর চাপ বাড়তে থাকে।
শ্রমিক-কর্মচারীদের মুখে হাসি ফিরেছে
কারখানায় উৎপাদন শুরু হওয়ায় নতুন করে প্রাণ ফিরে এসেছে শ্রমিক ও কর্মচারীদের মাঝে।
সিইউএফএলের কর্মচারী ঈসা খান বলেন,
“দীর্ঘদিন বসে বসে বেতন নিতে কারোই ভালো লাগে না। কারখানায় উৎপাদন শুরু হওয়ায় সবাই এখন অনেক আনন্দিত। যদি সারাবছর নিয়মিত চালু থাকে, তাহলে আমাদের জীবিকা আরও স্বচ্ছল হবে।”
স্থানীয় জনগণও জানাচ্ছেন, কারখানাটি চালু থাকলে এলাকার অর্থনীতি সচল থাকে। আনোয়ারা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছোট ব্যবসা, পরিবহন, বাজার—সবকিছুতেই সিইউএফএলের প্রভাব পড়ে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্য
সিইউএফএলের এমডি মিজানুর রহমান বলেন,
“দীর্ঘ অপেক্ষার পর গ্যাস সরবরাহ পাওয়ায় আমরা ইউরিয়া উৎপাদন শুরু করেছি। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা। যদি সেটি পাওয়া যায়, আমরা দ্রুতই আগের ক্ষতিগুলো পুষিয়ে নিতে পারব।”
তিনি আরও বলেন, “এই কারখানার পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন শুরু হলে বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদন সম্ভব। এটি দেশের সার চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা রাখবে।”
বাংলাদেশে ইউরিয়া সারের গুরুত্ব
বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে ইউরিয়া সারের ভূমিকা অপরিসীম। দেশে বছরে প্রায় ২৬ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়।
এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক আসে স্থানীয় কারখানা থেকে, বাকিটা আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে—বিশেষ করে সৌদি আরব, কাতার, ওমান ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।
সিইউএফএল, জামালপুরের জিএফসিএল, গাইবান্ধার পলাশ ইউরিয়া ফ্যাক্টরি, আশুগঞ্জ ইউরিয়া ফ্যাক্টরি—সবগুলোই দেশে ইউরিয়া সরবরাহের মূল কেন্দ্র।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় এই কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা কমে গেছে, যার ফলে আমদানির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব: আমদানি নির্ভরতা কমানোর সুযোগ
সিইউএফএল আবারও পূর্ণ উৎপাদনে ফিরলে সরকারের আমদানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।
প্রতি বছর ইউরিয়া আমদানিতে বাংলাদেশকে গড়ে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়লে এই খরচের একটি বড় অংশ সাশ্রয় সম্ভব।
এছাড়া ইউরিয়া সার কৃষকদের কাছে সহজলভ্য হলে ফসল উৎপাদন ব্যয়ও কমে আসবে। কৃষকরা কম দামে সার পেয়ে লাভজনকভাবে ফসল উৎপাদন করতে পারবেন, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গ্যাস সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার আহ্বান
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সিইউএফএল টিকিয়ে রাখতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ।
গ্যাসের অভাবে একাধিকবার কারখানাটি বন্ধ হয়েছে, যা শুধুমাত্র উৎপাদন নয়—যন্ত্রপাতিরও ক্ষতি করে।
গ্যাস সরবরাহে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন শিল্প বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহীনুল ইসলাম বলেন,
“রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোকে টেকসই করতে হলে গ্যাস সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। বারবার বন্ধ হলে শুধু উৎপাদন নয়, রাষ্ট্রের সম্পদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
সিইউএফএল আধুনিকায়নের দাবি
সিইউএফএল প্রতিষ্ঠিত হয় প্রায় তিন দশক আগে। বর্তমানে এর অধিকাংশ যন্ত্রপাতি পুরোনো এবং কম কার্যকর।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারখানাটির আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য একটি প্রস্তাব ইতিমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। নতুন মেশিন স্থাপন করলে উৎপাদন দ্বিগুণ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বন্দরনগরীর ব্যবসায়ী নেতারাও কারখানাটি আধুনিক করার দাবি জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, সিইউএফএল কেবল সার উৎপাদন কেন্দ্র নয়—এটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের অর্থনীতির প্রাণ।পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব
সিইউএফএল পুনরায় চালু হওয়ায় শুধু শিল্প নয়, সামাজিক প্রভাবও ইতিবাচকভাবে দেখা যাচ্ছে।
কারখানার আশেপাশে হাজারো মানুষের জীবিকা জড়িয়ে আছে। দোকানদার, পরিবহন শ্রমিক, খুচরা ব্যবসায়ী—সবাই নতুন করে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন।
তবে পরিবেশবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, কারখানাটি চালু রাখার পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সিইউএফএল দীর্ঘদিন টেকসইভাবে চলতে পারবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সিইউএফএলকে দেশের অন্যতম আধুনিক সার কারখানায় রূপান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় আধুনিক কন্ট্রোল সিস্টেম, জ্বালানি সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি এবং ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থা স্থাপনের কথা ভাবা হচ্ছে।
এর ফলে ইউরিয়া উৎপাদন আরও স্থিতিশীল হবে এবং আন্তর্জাতিক মানে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করবে।
দীর্ঘ সাত মাস পর আনোয়ারার সিইউএফএলে ইউরিয়া উৎপাদন শুরু হওয়ায় নতুন আশার আলো দেখছে দেশের কৃষি ও শিল্পখাত।
যদি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ ও আধুনিকায়ন কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে সিইউএফএল আবারও বাংলাদেশের কৃষির স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারবে।
এই পুনরুজ্জীবন কেবল একটি কারখানার গল্প নয়—এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্প উন্নয়ন এবং শ্রমজীবী মানুষের আশার প্রতীক।
MAH – 13597 I Signalbd.com



