বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ধীরে ধীরে তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করছে। সোমবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজধানীর গুলশান কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন।
তবে আলোচিত ও জনপ্রিয় বিএনপি নেত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য ও আইনজীবী রুমিন ফারহানা এবার প্রাথমিক তালিকায় নাম পাননি। তাঁর আসন ঘোষণাও স্থগিত রাখা হয়েছে, যা দলীয় মহল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
মনোনয়ন ‘অন হোল্ড’: কী বললেন রুমিন ফারহানা
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন,
“আমার মনোনয়ন আপাতত ‘অন হোল্ড’ রয়েছে। বিএনপির দীর্ঘদিনের সহযোগী কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোটগত সমঝোতার কারণেই ৬৩টি আসনের তালিকা এখনো ঘোষণা করা হয়নি। পাশাপাশি, নতুন কয়েকটি দলের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।”
তিনি আরও বলেন, “গত ১২-১৫ বছর ধরে যেসব দল সুখে-দুঃখে বিএনপির পাশে থেকেছে, তাদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আলাপ চলছে। তাই কিছু আসন এখনো ঝুলে আছে। দল ‘উইনেবল’ প্রার্থী নির্বাচন করতে চায়, সেই বিবেচনায় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।”
মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, বিএনপির বিভিন্ন এলাকায় মনোনয়ন না পাওয়া প্রার্থীরা রাস্তায় বিক্ষোভ করছেন, টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করছেন। এই বিষয়ে রুমিন ফারহানা বলেন,
“বড় দলে প্রার্থীর সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে। একেকটি আসনে ১০-১২ জন করে আবেদন করেন। সবার প্রত্যাশা থাকে মনোনয়ন পাওয়া। তাই বাদ পড়লে মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। তবে আমি মনে করি, নেতাকর্মীদের আবেগকে শ্রদ্ধা করা উচিত, কিন্তু এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।”
তিনি আরও বলেন, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রার্থীদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন এবং মনোনয়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করেছেন। এটি সম্পূর্ণভাবে একটি যৌক্তিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত।”
“এখনও সময় আছে, পরিবর্তন আসতে পারে”
রুমিন ফারহানা ইঙ্গিত দেন যে প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত নয়। তিনি বলেন,
“যে তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছে, সেটি প্রাথমিক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পরিবর্তন আসতে পারে। কেউ বাদ পড়তে পারেন, আবার নতুন কেউ যুক্তও হতে পারেন। নির্বাচন কমিশনের কিছু আইনি জটিলতার কারণেও কয়েকটি আসনের প্রার্থিতা ঘোষণা স্থগিত আছে। যেমন বাগেরহাট-২ আসন তারই একটি উদাহরণ।”
বিএনপির কৌশলগত অবস্থান
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি এবার প্রার্থী বাছাইয়ে অতীতের তুলনায় আরও কৌশলগতভাবে এগোচ্ছে।
তারা শুধুমাত্র জনপ্রিয় বা সিনিয়র নয়, বরং মাঠপর্যায়ে ভোটের যোগ্যতা ও সাংগঠনিক সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
দলটি ‘উইনেবল ক্যান্ডিডেট’ অর্থাৎ জেতার সম্ভাবনা থাকা প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এজন্যই কিছু আলোচিত নাম, যেমন রুমিন ফারহানা, আপাতত অপেক্ষার তালিকায় আছেন বলে জানা গেছে।
রাজনীতিবিদদের মতে, বিএনপি এবার প্রার্থীদের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী মাঠে নামার বার্তা দিচ্ছে। তবে এর মধ্যেও দলে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা এবং জোট রাজনীতির প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
জোট রাজনীতির নতুন সমীকরণ
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ছাড়াও নতুন কিছু দলকে অন্তর্ভুক্ত করে বৃহত্তর বিরোধী ঐক্য গঠনের চেষ্টা চলছে।
সূত্র অনুযায়ী, জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও মাঠ পর্যায়ে সমন্বয় চলছে। পাশাপাশি, নাগরিক ঐক্য, লেবার পার্টি, কল্যাণ পার্টি এবং কয়েকটি আঞ্চলিক সংগঠনের সঙ্গেও আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
এই সমঝোতাগুলোর কারণেই ৬৩টি আসন নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এসব আসনের মধ্যে কিছুর মধ্যে ধানমণ্ডি, গুলশান, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, বাগেরহাট, বগুড়া, রংপুর ও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ আসন রয়েছে।
ফজলুর রহমানের মনোনয়ন ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
বিএনপির আলোচিত নেতা ফজলুর রহমান কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম) থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন।
এই সিদ্ধান্ত সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, দলের নিবেদিতপ্রাণ ও জনপ্রিয় নেতাদের বাদ দিয়ে কিছু বিতর্কিত নাম কেন অন্তর্ভুক্ত করা হলো।
তবে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি, ফজলুর রহমান সংগঠনের প্রতি দীর্ঘদিনের অবদান ও স্থানীয় প্রভাবের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: রুমিন ফারহানার ভূমিকা ও গুরুত্ব
রুমিন ফারহানা শুধু একজন সংসদ সদস্য বা নেত্রী নন; তিনি বিএনপির তরুণ ও আধুনিক ভাবধারার প্রতিনিধিত্ব করেন।
সংসদে তাঁর বক্তৃতা, টকশোতে যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ ও সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা তাঁকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত মুখ করে তুলেছে।
রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান অনেকটা বিএনপির “বুদ্ধিবৃত্তিক মুখ” হিসেবে গড়ে উঠেছে।
তাই তাঁর মনোনয়ন না পাওয়া বা স্থগিত হওয়া নিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে আলোচনা স্বাভাবিক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,
“রুমিন ফারহানা বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের একটি সম্ভাবনাময় মুখ। দল যদি তাঁর মত তরুণ নেতৃত্বকে যুক্ত রাখে, তাহলে তা ভবিষ্যতের রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
রুমিন ফারহানার বার্তা সমর্থকদের প্রতি
দলের ভেতর হতাশা সত্ত্বেও তিনি সমর্থকদের প্রতি সংযম ও ধৈর্যের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমাদের দল এখনো প্রক্রিয়াধীন পর্যায়ে আছে। আসন ভাগাভাগি, জোট সমন্বয় ও আইনি বাধা দূর হলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।”
বিএনপির পরবর্তী পদক্ষেপ
বিএনপির পরবর্তী ধাপে বাকি ৬৩টি আসনের প্রার্থী ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন,
“আমরা এখনো জোট সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই বাকি আসনগুলোর প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।”
তিনি আরও জানান, “এবার আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি তরুণ নেতৃত্ব, নারী প্রার্থী ও মাঠপর্যায়ের ত্যাগী কর্মীদের ওপর।”
রুমিন ফারহানার মনোনয়ন স্থগিত হওয়া বিএনপির অভ্যন্তরীণ কৌশল ও জোট রাজনীতির একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরছে।
তিনি আপাতত মনোনয়ন তালিকায় না থাকলেও, তাঁর সক্রিয়তা ও অবস্থান দলীয় রাজনীতিতে এখনও দৃঢ়।
বিশ্লেষকদের মতে, “এমন কৌশলগত মনোনয়ন স্থগিত সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত বিএনপির পক্ষে ইতিবাচক হতে পারে, যদি তারা সঠিক প্রার্থীদের মাধ্যমে শক্তিশালী মাঠে নামতে পারে।”
নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, বিএনপির প্রার্থী তালিকা ও জোট রাজনীতির জট খুলতে ততই আগ্রহ বাড়ছে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও।
MAH – 13605 I Signalbd.com



