প্রযুক্তি

নাসা’র নভোচারী ধরে ফেললেন বায়ুমণ্ডলের বিরল ‘স্প্রাইট’

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে নাসা’র ‘স্প্রাইট’ ধরা পড়ল নজরে

বিজ্ঞান ও মহাকাশ গবেষণার অঙ্গনে আবারো এক বিরল ও আকর্ষণীয় ঘটনা ঘটেছে। নাসা’র নভোচারী নিকোল আয়ার্স আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) থেকে বায়ুমণ্ডলের একটি অত্যন্ত বিরল ঘটনা ‘স্প্রাইট’ ক্যামেরাবন্দী করেছেন। স্প্রাইট হচ্ছে মেঘের উপরের স্তরে আকস্মিক আলোর ঝলকানি, যা বজ্রঝড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। ৩ জুলাই, আইএসএস থেকে আমেরিকা ও মেক্সিকো অঞ্চলের আকাশপথ পারাপারের সময় নিকোল আয়ার্স এই অপরূপ আলোর এক মনোমুগ্ধকর ছবি তুলে তা নিজের এক্স (আগে টুইটার) অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেন।

‘স্প্রাইট’ কি এবং কেন তা এতই বিরল?

স্প্রাইট হচ্ছে এক প্রকার ট্রানজিয়েন্ট লুমিনাস ইভেন্ট (Transient Luminous Event বা TLE), যা মেঘের উপরে উচ্চ বায়ুমণ্ডলে সৃষ্টি হয়। মূলত মেঘ থেকে ভূমির দিকে আঘাত হানানো শক্তিশালী পজিটিভ বজ্রপাতের ফলে মেসোস্ফিয়ারে (পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০ থেকে ৮৫ কিলোমিটার উচ্চতায়) লালচে-কমলা আলোর ক্ষণস্থায়ী ঝলকানি তৈরি হয়, যাকে স্প্রাইট বলা হয়।

স্প্রাইটের বৈশিষ্ট্য হলো এর গাঢ় লাল ও কমলা রঙ এবং নীচের দিকে নীলচে শিরা বা ফিলামেন্টের মতো আকৃতি। এটি একেবারে অতি দ্রুত ঝলকায় এবং মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ড স্থায়ী হয়, তাই খালি চোখে পৃথিবী থেকে এটি দেখা অত্যন্ত কঠিন।

স্প্রাইটের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব ও কিভাবে এটি তৈরি হয়?

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, স্প্রাইট মূলত একটি ‘ঠান্ডা প্লাজমা’ যেটি মেঘের উপর অবস্থিত নাইট্রোজেন গ্যাসকে উত্তেজিত করে তৈরি হয়। পজিটিভ বজ্রপাতের সময় মেঘ থেকে ভূমিতে ধনাত্মক চার্জ প্রবাহিত হলে বায়ুমণ্ডলে একটি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। এই বৈদ্যুতিক প্রবাহ নাইট্রোজেনকে উত্তেজিত করে এবং তার থেকে লালচে আলোর ঝলকানি (স্প্রাইট) সৃষ্টি হয়।

স্প্রাইটের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বজ্রঝড়ের প্রকৃতি, বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরের বৈদ্যুতিক পরিবেশ এবং প্লাজমার আচরণ সম্পর্কে নতুন ধারণা পান।

স্প্রাইটের আকার ও তার দেখা পাওয়ার দুরূহতা

স্প্রাইট দেখতে অনেক রকম হতে পারে। কখনো জেলিফিশের মতো বিস্তৃত, কখনো গাজরের মতো সুতির আকৃতি বা স্তম্ভের মতো। যদিও স্প্রাইটের মাথা অংশ সাধারণত লালচে-কমলা, নিচের দিক নীলচে শিরার মতো হয়।

স্প্রাইটের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির কারণে, শুধুমাত্র মহাকাশ থেকে বা অত্যাধুনিক ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি দিয়ে পৃথিবী থেকেও স্প্রাইটের দৃশ্য ধরা সম্ভব। সাধারণ মানুষ বা পাইলটরা বহু বছর ধরেই স্প্রাইটের কথা বললেও, প্রথমবার এটি বৈজ্ঞানিকভাবে ১৯৮৯ সালে ছবি তোলা হয়। সেই সময় থেকে স্প্রাইট বায়ুমণ্ডলীয় একটি স্বীকৃত ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

নাসার নভোচারী নিকোল আয়ার্সের অভিজ্ঞতা

নিজের এক্স পোস্টে নিকোল আয়ার্স লিখেছেন, “আমি মেক্সিকো ও আমেরিকার ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম যখন হঠাৎ এই বিরল স্প্রাইট দেখতে পেলাম। এটি আমার জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।”

তিনি আরও যোগ করেছেন, “স্প্রাইটের ছবি থেকে বিজ্ঞানীরা বজ্রঝড়ের কার্যকলাপ এবং বায়ুমণ্ডলের গঠন সম্পর্কে আরও গভীর জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে আইএসএস থেকে দেখা এই ধরনের আলোর ঝলকানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশ গবেষণায় স্প্রাইটের গুরুত্ব

স্প্রাইটের পর্যবেক্ষণ মহাকাশ ও বায়ুমণ্ডল গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বজ্রঝড়ের সঙ্গে যুক্ত এই আলোর ঝলকানি শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং এটি বৈদ্যুতিক ও আকাশগঙ্গার গঠনগত বিশ্লেষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

মহাকাশ স্টেশন থেকে স্প্রাইট পর্যবেক্ষণ বিজ্ঞানীদের বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে বিদ্যুৎগত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া বোঝার সুযোগ দেয়। এর ফলে, আবহাওয়া পূর্বাভাস ও ভূ-বিদ্যুতের মডেল উন্নত করতে সহায়তা মিলবে।

স্প্রাইট সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য

  • প্রথম চিত্র: ১৯৮৯ সালে ক্যামেরাবন্দী হয় স্প্রাইটের প্রথম ছবি।
  • ঘটনার প্রকৃতি: এটি খুব দ্রুত ঘটে এবং মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ড স্থায়ী হয়।
  • দৃশ্যমানতা: পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে দেখা কঠিন, মহাকাশ থেকে সবচেয়ে ভালো দেখা যায়।
  • গবেষণা: নাসা ও অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্প্রাইট নিয়ে গবেষণায় ব্যাপক আগ্রহী।

নাসা’র নভোচারী নিকোল আয়ার্সের ক্যামেরায় বন্দি স্প্রাইটের ছবি বিশ্ব মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে এই বিরল ও রহস্যময় আলোর ঝলকানি পৃথিবী ও মহাকাশের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। স্প্রাইটের রহস্য জানার জন্য আগামীতেও গবেষণা অব্যাহত থাকবে, যা আমাদের বায়ুমণ্ডল ও আকাশের আরও গভীর সমঝোতার পথ প্রশস্ত করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button