বিশ্ব

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ: ৫ সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষয়ক্ষতি গোপন – টেলিগ্রাফ

গত জুন মাসে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘটিত তীব্র ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল ইসরায়েলের পাঁচটি প্রধান সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানেছিলো। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ শনিবার প্রথমবারের মতো একটি বিশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য গোপন রাখা হয়েছে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে। এই তথ্যের উৎস ছিলো অরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির স্যাটেলাইট থেকে সংগৃহীত স্যাটেলাইট ও রাডার ডেটা, যা যুদ্ধক্ষেত্রের ক্ষয়ক্ষতি নিরীক্ষণে ব্যবহৃত হয়।

ইসরায়েলের সেন্সরশিপ ও গোপনীয়তার কারণ

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী, আইডিএফ (Israel Defense Forces), তাদের ঘাঁটি ও অন্যান্য সেন্সিটিভ সামরিক স্থাপনের ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছে। তাদের যুক্তি, এই তথ্য প্রকাশ করলে ইরান তাদের মিসাইলগুলোর সঠিকতা বাড়ানোর জন্য এই তথ্য ব্যবহার করতে পারবে, যা ভবিষ্যতে ইসরায়েলের জন্য আরও বড় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

ক্ষতিগ্রস্ত সামরিক ঘাঁটিগুলো কোথায়?

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ক্ষতিগ্রস্ত ঘাঁটিগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • টেল নোফ বিমান ঘাঁটি — ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান বিমানঘাঁটি,
  • গ্লিলট গোয়েন্দা ঘাঁটি — গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু,
  • জিপ্পোরিট অস্ত্র ও যানবাহন উৎপাদন কেন্দ্র — যেখানে সামরিক অস্ত্র ও যানবাহন তৈরি করা হয়।

এই স্থাপনাগুলোতে ইরানের ছোড়া মোট ছয়টি রকেট আঘাত হানেছিলো, যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি করে।

যুদ্ধে মোট ক্ষয়ক্ষতি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

১২ দিনের যুদ্ধ চলাকালীন ইরান মোট ৫০০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং প্রায় ১,১০০টি ড্রোন ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করেছিলো। যদিও এই মিসাইল ও ড্রোনের অধিকাংশ ব্যর্থ হয়েছে, তথাপি কয়েকটি মিসাইল ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলো এবং সেগুলো ব্যাপক ক্ষতি ডেকে আনে।

তবে শুধু সামরিক স্থাপনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না ক্ষতি। রিপোর্ট অনুযায়ী:

  • ২৮ জন নিহত,
  • ২৪০টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত,
  • ২,৩০৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত,
  • দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি হাসপাতালও আঘাত পেয়েছে,
  • ১৩,০০০-এর বেশি নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

মিসাইল প্রতিরোধে ইসরায়েল-আমেরিকার চ্যালেঞ্জ

প্রতিবেদনে টেলিগ্রাফ জানিয়েছে যে যুদ্ধের প্রথম আট দিনে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ইরানি মিসাইল ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে, সপ্তম দিনে ইসরায়েলি ও আমেরিকান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ১৬ শতাংশ মিসাইল আটকাতে ব্যর্থ হয়েছিলো।

এই পরিস্থিতির পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে:

  • ইসরায়েল সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের জন্য তাদের ইন্টারসেপ্টর মিসাইলগুলো সংরক্ষণ করছিল,
  • ইরানের ব্যবহৃত মিসাইলগুলো আরও উন্নত প্রযুক্তির ছিল, যা ধ্বংস করা কঠিন ছিল,
  • যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের মিসাইল প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কমে গিয়েছিলো।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, ইসরায়েলের অ্যারো ইন্টারসেপ্টর মিসাইলগুলো শেষের দিকে পৌঁছে গিয়েছিলো এবং তাদেরকে কঠোরভাবে বেছে নিতে হয়েছে কোন মিসাইল ধ্বংস করতে হবে আর কোনটি বাদ দিতে হবে। যদিও আইডিএফ এই খবরটি খন্ডন করেছে এবং বলেছে, তারা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েছিল।

নতুন ধরনের বোমার ব্যবহার

১৯ জুন ইরানের তরফ থেকে নতুন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিলো। এটি ছিলো ক্লাস্টার বোমার ওয়ারহেড, যা এক সঙ্গে অনেক ছোট বিস্ফোরক ক্ষেপণাস্ত্র ছড়িয়ে দেয়। এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই ক্লাস্টার বোমার একটি ছোট মারণাস্ত্র আজোর শহরের একটি বাড়িতে আঘাত হানে, যা ছোট একটি রকেটের সমতুল্য ক্ষতি করে।

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি

ইসরায়েল স্পষ্ট করে বলেছে যে তারা ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক মিসাইল কর্মসূচি ধ্বংস করতে গত ১৩ জুন এই সামরিক অভিযান শুরু করে। তারা জানিয়েছে, ইরানের লক্ষ্য ইহুদি রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করা, যা তাদের রক্ষা করা একান্ত জরুরি।

অন্যদিকে, ইরান সবসময়ই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা অস্বীকার করে আসছে। তবে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা বারবার জানিয়েছেন যে, ইরান তাদের পারমাণবিক স্থাপনায় পরিদর্শকদের বাধা দেয় এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে। ইসরায়েলের দাবি, ইরান সাম্প্রতিককালে তাদের অস্ত্র উৎপাদনে আরও উন্নতি সাধন করেছে।

সার্বিক বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

এই ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল ও ড্রোন হামলার মাত্রা ও প্রকৃতি প্রকাশ করে যে ইরানের সামরিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। ইসরায়েল যাই বলুক, সামরিক ঘাঁটিগুলোতে আঘাতের তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা যুদ্ধের বাস্তবতাকে পুরোপুরি লুকানো সম্ভব নয়।

ভবিষ্যতে এই ধরনের সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি হলে ইসরায়েল ও তার মিত্ররা কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে এবং তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হবে তা আন্তর্জাতিক সমাজের নজরদারির মধ্যে থাকবে।

সঙ্গে সঙ্গে, ইরান ও ইসরায়েলের পারমাণবিক প্রতিযোগিতা বিশ্ব শান্তির জন্য বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে, যা পরবর্তী বছরগুলোতে গ্লোবাল পলিটিক্স ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button