অর্থনীতি

৫৪ বছরে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক: সুবিধা-অসুবিধার ভারসাম্য বিশ্লেষণ

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত একরাশ চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারকে বাঁধা পড়ে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক। ৫৪ বছর ধরে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধুত্বের খাতায়-কলমে গড়ে ওঠা এই সম্পর্কের আড়ালে আছে সুযোগ-সুবিধা ও অসুবিধার মিশ্রণ। এই প্রতিবেদনে আমরা দেখবো, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ কী কী সৌজন্য পেয়েছে, কতটা ফিরিয়ে পেয়েছে এবং কোথায় দোটানা রয়ে গেছে।

মৈত্রী চুক্তি: বন্ধুত্বের সূচনা

১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ–ভারত মৈত্রী চুক্তি ছিল freshly স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক বন্ধুত্বসূচক পদক্ষেপ। শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীচরিত এই ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত ও রাজনৈতিক সমর্থনের প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু ১৯৯৭ সালে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া পরও নবায়ন না হওয়ায় মৈত্রী রূপে সম্পর্কের সেই উষ্ণতা আদর্শিক পর্যায়ে আটকে যায়।

১৯৭২–১৯৭৫: বাণিজ্য ও জলপথে ত্বরান্বিত সহযোগিতা

  • ২৮ মার্চ ১৯৭২: দুই দেশের প্রথম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর, যেখানে সীমান্তের ১৬ কিমি ভিতরে পণ্য-বিনিময় ও ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে এক বছরের জন্য প্রাথমিক রূপায়ণ।
  • ২ নভেম্বর ১৯৭২: ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট প্রোটোকল, উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে নদীপথে সরাসরি যোগাযোগের পথ প্রশস্ত করে।
  • ৫ জুলাই ১৯৭৩: তিন বছর মেয়াদি বাণিজ্য চুক্তি, বছরে প্রায় ৬১ কোটি টাকার পণ্য-লেনদেন অনুমোদন।
  • ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪: ট্রেড অ্যান্ড পেমেন্টস অ্যারেঞ্জমেন্ট (টিপিএ) চুক্তি, দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাধ্যমে বালেন্স অব পেমেন্টস ক্লিয়ারিং ব্যবস্থার সূচনা।
  • ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭৪: টাকার বাণিজ্য পরিত্যাগ করে মুক্ত রূপান্তরযোগ্য মুদ্রায় লেনদেনের সিদ্ধান্ত, যা ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়।

এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ নদীপথ, সড়কপথ ও বাণিজ্যে ভারতের নানান সুবিধা দিয়ে আসে – সিমেন্ট, রপ্তানি পণ্য, নেটওয়ার্ক ইত্যাদি। বিনিময়ে ঢাকায় ঢুকেছিল এ্যাসফল্ট, কেমিক্যাল, স্প্যাশাল কনসট্রাকশন মেটেরিয়াল।

১৯৭৫–২০০৮: সম্পর্কের ওঠাপড়া ও সম্প্রসারণ

  • ১৯৭৫ সালে অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক শঙ্কায়–ফারাক্কা বাঁধ ইস্যুতে এবং অভ্যুত্থানের পর ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক এক পর্যায়ে শীতলায়ন হতে থাকে।
  • ১৯৮০, ১৯৮৩ সালে বাণিজ্য ও ট্রানজিট চুক্তির নবায়ন, কিন্তু সুবিধা–অসুবিধার ভারসাম্য নিশ্চিত হয়নি।
  • ১৯৯৩ সালে সাপটা (SAFTA) স্বাক্ষর, ২০০৬ সালে সাফটা কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মুক্ত বাণিজ্যযজ্ঞে বাংলাদেশও অংশ নেয়।
  • ১৩ আগস্ট ২০০৮: WTO’র এলডিসি ডিএফটিপি–স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৃষি, হস্তশিল্প সুবিধাভোগী পণ্যের শুল্কমুক্ত সম্ভার।

শেখ হাসিনা সরকারের জলছবি (২০১০–২০১৫)

২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর ২০১০–২০১১ সালে শেখ হাসিনা ও মনমোহন সিংহের বিনিময় সফরে একের পর এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়:

  1. সমুদ্র, রেল ও সড়ক পথে উভয় দেশ পারস্পরিক ব্যবহার।
  2. চট্টগ্রাম–মোংলা বন্দর নেপাল ও ভুটানের ট্রানজিটের জন্য উন্মুক্ত।
  3. আশুগঞ্জ–শিলঘাট নৌপথ, রেলপথ সংস্কার ও যোগাযোগ উন্নয়নে $১০০ কোটি ঋণ সহায়তা।
  4. ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎযোগাতে ভারতের প্রতিশ্রুতি।
  5. তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে ত্বরিত পদক্ষেপের কথা, যা আজও টানাবানা।

২০১১ সালে চুক্তি হলো: ৪৬টিরও বেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, জয়েন্ট টহল, ছিটমহলবাসীর পাসপোর্টবিহীন চলাচল প্রভৃতি। কিন্তু তিস্তা চুক্তি এত দিন হয়নি, মমতার বাধা ও রাজনীতির খাঁড়াকেটে।

নরেন্দ্র মোদির “বন্ধুত্বের সফর” (২০১৫)

৬ জুন ২০১৫ তাঁর প্রথম ঢাকা সফরে:

  • এলবিএ বাস্তবায়ন, ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ে কাগজপত্র হস্তান্তর।
  • $২০০ কোটি লাইন অব ক্রেডিট।
  • উপকূলীয় শিপিং, রেল রুট পুনর্চালু।
  • সীমান্ত হাট সম্প্রসারণ, বিদ্যুৎ সংযোগ, শিক্ষা–সংস্কৃতি বিনিময়।
  • নৌ–ট্রানজিট প্রটোকল স্বয়ংক্রিয় নবায়ন ব্যবস্থা।

পরে ২০২০ সালে এ প্রটোকলে নতুন রুট ও বন্দর সংযোজন—হলদিয়া, মোংলা ইত্যাদি।

আধুনিক যুগের নানা চ্যালেঞ্জ ও সমঝোতা

  • ২০১৭: আদানি পাওয়ারের সঙ্গে ১,৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ চুক্তি—উচ্চমূল্য, পরিবেশ-সমালোচনা।
  • ২০১৮–২০২০: চট্টগ্রাম–মোংলা বন্দরে ভারতীয় ট্রানজিট সুবিধা; পরীক্ষামূলক চালান।
  • ১৮ মার্চ ২০২৩: ১৩১.৫৭ কিমি ডিজেল পাইপলাইন উদ্বোধন, ১৫ বছরের চুক্তি অনুযায়ী বছরে ২.৫–৪ লাখ টন আমদানির পথ।
  • ১ এপ্রিল ২০২৩: চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে স্থায়ী ট্রানজিট অনুমতি, এনবিআর–এর ট্রানজিট আদেশ।
  • ৮ এপ্রিল ২০২৫: ভারতীয় “ট্রানজেকশিপমেন্ট” সুবিধা বাতিল, সিবিআইসি–এর নির্দেশনায় বাংলাদেশি পণ্য ট্রানজিট সীমিত।
  • ১৫ এপ্রিল ২০২৫: বাংলাদেশী এনবিআর ভারতের বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী দিয়ে সুতা আমদানি बंद।
  • ১৭ মে ২০২৫: ভারতের স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক, প্রসেসড ফুড, প্লাস্টিক, আসবাব–সহ পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপ; কলকাতা ও মুম্বাই বন্দরের বাইরে অন্য কোনো স্থলপথ ব্যবহার নিষেধ।

এই সিদ্ধান্তগুলো দুই দেশের বাণিজ্য–অর্থনীতিতে দুষ্টচক্র সৃষ্টি করেছে। আখাউড়া, বেনাপোল পোর্টে দুই দিন ধরে পণ্য অপেক্ষারত, ব্যবসায়ীর অর্থ-সময় অপচয়।

সুবিধা বনাম প্রতিদান: মুখোমুখি তুলনা

প্রদানকৃত সুবিধাবাংলাদেশে প্রাপ্ত সুবিধা
ট্রানজিট সুবিধা, বন্দরের ব্যবহার (চট্টগ্রাম, মোংলা)সীমিত ঋণসহায়তা, প্রণোদনা, দিকনির্দেশনা
ডিজেল পাইপলাইন, বিদ্যুৎ সরবরাহ (২৫০ মেগাওয়াট)+বিদ্যুৎ–ঘাটতি কিছুটা শমন, উচ্চমূল্যী বিদ্যুৎ
নদীপথ–সড়ক–রেল সংযোগযোগাযোগ উন্নয়নে অংশ–প্রকল্প, আদর্শিক অগ্রগতি
ঋণসীমা (লাইন অব ক্রেডিট $২০০ কোটি)+প্রকল্পে ভারতীয় কন্ট্রাক্টর নিয়োগের শর্ত
শিক্ষা–সংস্কৃতি বিনিময় প্রোগ্রামগবেষণা–প্রকাশনা সহায়তা, শিক্ষার্থীবিনিময় সীমিত

তিস্তা পানি বণ্টন আজও অসম্পন্ন অনিশ্চয়তার মধ্যে। ট্রানজিট থেকেও বিশেষ ধরনের আর্থিক লাভ আসেনি। ঋণ আসলেও শর্তাধীন প্রকল্পে প্রকৃত “বিল্ডিং ব্লক” কম।

৫৪ বছরের সম্পর্ক দেখলে বোঝা যায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে নানা পর্যায়ে দান-প্রতিদানের ভারসাম্য খুঁজতে ছুটেছে। রাজনৈতিক সমর্থন, কৌশলগত বন্ধন গড়ার স্বার্থে অনেক কিছু ছেড়ে এসেছে; কখনো ট্রানজিট, বন্দরের ব্যবহার, মুদ্রা–বিনিময় সুবিধা, নদীপথ ট্রেড—সবই দিয়েছে। পাল্টা পেয়েছে ঋণ, লো-শুল্ক প্রবেশ সুবিধা, অবকাঠামোর অঙ্গীকার; তবে প্রকৃত লভ্যাংশ ও শর্তহীন অধিকার আজও আসেনি।

আগামী দিনে দরকার সঠিক কৌশল, দৃঢ় কূটনৈতিক অবস্থান, পরিশুদ্ধ অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যাক ন্যায্য সুবিধা—চুক্তিতে ঘোষণার বাইরে বাস্তবায়ন ও তদারকি। তাহলেই ৫৫তম বছরে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক হবে সমমানের, স্বার্থপর নয়, পরস্পর শ্রদ্ধাশীল ও লাভবান

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button