মঞ্জুর এলাহীর মতো ব্যবসায়ী উপমহাদেশে বিরল: রেহমান সোবহান

বাংলাদেশের অন্যতম স্বনামধন্য ব্যবসায়ী সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে উপমহাদেশের ব্যবসায়িক ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, মঞ্জুর এলাহীর মতো ব্যবসায়ী ভারতীয় উপমহাদেশে বিরল।
শুক্রবার ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে তাঁর দোয়া মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। বক্তারা বলেন, তিনি শুধু একজন সফল ব্যবসায়ীই নন, বরং একজন আদর্শ মানুষ, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর সততা, দায়বদ্ধতা এবং নৈতিকতা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।
সততা ও নৈতিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘‘টাকা-পয়সা ও ক্ষমতা আসার পর সাধারণত মানুষের মধ্যে ঔদ্ধত্য দেখা যায়, কিন্তু সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন সদা বিনয়ী, মার্জিত ও বন্ধুবৎসল।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমার ৯০ বছর বয়সে এসে আমার এক ছাত্রের স্মরণসভায় অংশ নিতে হবে, তা ভাবিনি। তবে তিনি এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, যা আমাদের গর্বিত করে।’’
পেশা নির্বাচনে ব্যতিক্রমী পথচলা
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর পিতা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধান বিচারপতি। তাঁর পরিবারের অনেকেই বিচার বিভাগে উচ্চপদস্থ ছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যবসায়ের পথ বেছে নেন এবং বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন। করাচিতে উচ্চপদে চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যবসায় নেমে আসেন। চামড়ার ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করেন এবং এই খাতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘‘তিনি চাইলে সহজেই রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্জন করতে পারতেন, কিন্তু তা না করে সততা ও সাহসের সঙ্গে ব্যবসায়কে এগিয়ে নিয়েছেন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বাংলাদেশের চামড়াশিল্পকে রপ্তানি খাতে নিয়ে আসতে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে।’’
শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ছিলেন অত্যন্ত শিক্ষানুরাগী। ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘‘ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি না থাকলে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠত না।’’ বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত।
তাঁর সন্তান নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘‘বাবা সব সময় বলতেন, শ্রদ্ধা কখনো আদায় করা যায় না, অর্জন করতে হয়। তিনি সংখ্যালঘুদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং সব সময় বলতেন, কোনো অবস্থাতেই দেশ ছেড়ে যাওয়া যাবে না।’’
বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক সাফল্য
অ্যাপেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি শুধু নিজের কোম্পানিকেই বড় করেননি, বরং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, ‘‘তিনি ছিলেন একজন সুদূরপ্রসারী চিন্তার মানুষ। তাঁর বিনিয়োগ ও নেতৃত্বগুণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।’’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘‘দেশের রাজস্ব বৃদ্ধিতেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। কর কাঠামোকে সহজ করে ব্যবসার পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন।’’
সততা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মূর্ত প্রতীক
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ছিলেন একজন সজ্জন ব্যক্তি। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘তিনি বন্ধুবৎসল ও অত্যন্ত দায়িত্বশীল মানুষ ছিলেন। আমাদের অনেক বন্ধুর কঠিন সময়ে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন।’’
উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ অনেকে। এছাড়াও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
সমাপ্তি
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ১২ মার্চ ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর চলে যাওয়া দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সমাজের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তবে তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার শিক্ষাগুলো আগামীর প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।