অর্থনীতি

দুর্নীতির কারণে দেশে সড়ক নির্মাণে অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ অর্থ অপচয়

বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ খাতে অতিরিক্ত ব্যয়ের অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে দুর্নীতি ও অনিয়ম। উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থের অপচয়, নিম্নমানের কাজ এবং অদক্ষ পরিকল্পনার ফলে দেশের সড়ক খাতে ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, দেশের রাস্তা নির্মাণে ব্যয় আশপাশের দেশের তুলনায় বেশি এবং এর প্রধান কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারি থাকলে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ব্যয় কমানো সম্ভব

তিনি বলেন—

“রাস্তাঘাট দুর্নীতির বড় ক্ষেত্র। এই দুর্নীতি কমালে এবং প্রকৌশলীরা নজরদারি বাড়ালে রাস্তা নির্মাণের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যাবে।”

গাজীপুরে ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন

রবিবার (২৪ আগস্ট) সকালে গাজীপুরের ভোগড়া এলাকায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনের সময় তিনি এসব কথা বলেন। এই এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে ঢাকা শহরের যানজট কিছুটা কমবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন উপদেষ্টা।

সড়ক নির্মাণে দুর্নীতির চিত্র

বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো—

দুর্নীতি ও অনিয়ম: ঠিকাদার ও প্রভাবশালী মহলের কারসাজি।
অতিরিক্ত বিলিং ও ঘুষ: প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে-পরে বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম।
নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার: দীর্ঘস্থায়ী রাস্তার পরিবর্তে স্বল্পস্থায়ী রাস্তায় বিনিয়োগ।
দুর্বল নজরদারি: প্রকল্পে স্বচ্ছতার অভাব।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় ১.৫ থেকে ২ গুণ বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—ভারত বা নেপালে যেখানে এক কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে গড় খরচ হয় ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা, সেখানে বাংলাদেশে সেই খরচ দাঁড়ায় ৬ থেকে ৮ কোটি টাকা।

সমাধান কীভাবে সম্ভব?

উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন—
“সড়কের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। আমাদের রেলপথ, নদীপথ এবং বিমান যাতায়াতকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।”
তিনি জানান, সড়ক খাতে ব্যয় কমাতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, দুর্নীতি রোধ, এবং প্রকল্পে দক্ষ ব্যবস্থাপনা জরুরি। এছাড়াও, রাস্তায় টেকসই উপকরণ ব্যবহার করলে প্রতি বছর রাস্তা মেরামতের প্রয়োজন হবে না।

অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রকৃত কারণ: গভীর বিশ্লেষণ

১. পরিকল্পনার ঘাটতি: উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে প্রয়োজনীয় স্টাডি ও ডিজাইন করা হয় না।
২. অতিরিক্ত লালফিতার দৌরাত্ম্য: অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ এবং অনিয়ম।
৩. প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো: বারবার সময় বৃদ্ধি করে অর্থের অপচয়।
৪. বিদেশি ঠিকাদারের ওপর নির্ভরতা: দেশীয় ঠিকাদারদের সুযোগ না দিয়ে বাইরের কোম্পানির কাজ দেওয়া।

বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থার গুরুত্ব

বাংলাদেশে বর্তমানে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের প্রায় ৮০ শতাংশ সড়কপথের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে রাস্তায় চাপ বাড়ছে, যানজট ও দুর্ঘটনা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কপথের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রেলপথ ও নদীপথকে উন্নত করা জরুরি

রেলপথ: দীর্ঘ ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহনে রেল সবচেয়ে নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী।
নদীপথ: বাংলাদেশে নদীপথের বিশাল সম্ভাবনা আছে, যা এখনও পূর্ণ মাত্রায় কাজে লাগানো হয়নি।
বিমান পরিবহন: অভ্যন্তরীণ রুটে ছোট বিমানের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।

ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ের গুরুত্ব

ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো—ঢাকার যানজট কমানো এবং মালামাল পরিবহনের গতি বাড়ানো। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদীকে সংযুক্ত করবে। এর ফলে ঢাকার ভেতরের চাপ কিছুটা কমবে এবং পণ্যবাহী ট্রাকগুলো শহরের বাইরে দিয়ে চলাচল করতে পারবে।

প্রকল্পে চীনা ঠিকাদার কাজ করছে বলে জানা গেছে। উপদেষ্টা বলেছেন—
“প্রযুক্তি উন্নত করতে হবে। যাতে বছর বছর রাস্তা খারাপ না হয় এবং নতুনভাবে সংস্কারের জন্য টাকা খরচ করতে না হয়।”

দুর্নীতি রোধে করণীয়

বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক খাতে দুর্নীতি রোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:

ই-টেন্ডারিং ও ডিজিটাল মনিটরিং চালু করা।
কাজের মান নিয়ন্ত্রণে স্বাধীন সংস্থা গঠন
স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অনলাইন প্রজেক্ট ট্র্যাকিং সিস্টেম
প্রকল্পের অর্থায়ন ও ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ অডিট প্রতিবেদন প্রকাশ

আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ অপরিহার্য। যদি দুর্নীতি রোধ করা না যায়, তবে অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি জনগণের করের টাকায় তৈরি অবকাঠামোও দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

সড়ক নির্মাণে দুর্নীতি শুধু অর্থের অপচয়ই ঘটাচ্ছে না, এটি দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আমরা রেলপথ, নদীপথ এবং বিমান পরিবহনকে সমান গুরুত্ব দিই, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করি, তবে সড়ক খাতে ব্যয় অন্তত ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব।

এখন সময় দুর্নীতি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই হবে।

MAH – 12467 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button