ঋণ ব্যবস্থাপনায় আরও স্বচ্ছতা চায় বিশ্বব্যাংক

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বৈশ্বিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার ঘাটতির বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলছে, অনেক দেশই সরকারি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ গোপন রাখছে, এমনকি ঋণ সংগ্রহের জটিল এবং অপারদর্শী পদ্ধতির কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রকৃত ঋণ পরিস্থিতি বোঝা কঠিন হয়ে উঠেছে। এ কারণে, ঋণ গ্রহণ, ব্যবস্থাপনা এবং পরিশোধ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতে মৌলিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
স্বচ্ছতার অভাব: অর্থনৈতিক ঝুঁকির শঙ্কা
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্নআয়ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই এমন ঋণপদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে, যা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে না। এর মধ্যে রয়েছে—
- প্রাইভেট প্লেসমেন্ট: যেখানে সরকার গোপনে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে।
- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে মুদ্রা বিনিময় চুক্তি: যা আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা বা জনসম্মুখে প্রকাশের আওতায় পড়ে না।
- বন্ধক রাখা সম্পদের বিনিময়ে ঋণ গ্রহণ: যেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু শর্তাবলি অজানা থাকে।
এ ধরনের ব্যবস্থা শুধু ঋণের পরিমাণ নির্ধারণকেই দুরূহ করে তোলে না, বরং ভবিষ্যতে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতাও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
প্রকাশ্য তথ্যের ঘাটতি
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের আগে মাত্র ৬০ শতাংশ নিম্নআয়ভুক্ত দেশ ঋণসংক্রান্ত ন্যূনতম তথ্য প্রকাশ করত। বর্তমানে এই হার ৭৫ শতাংশে উন্নীত হলেও মাত্র ২৫ শতাংশ দেশ তাদের নতুন ঋণের চুক্তির বিস্তারিত তথ্য বা শর্তাবলি প্রকাশ করে থাকে।
এমনকি অনেক দেশ এখন অভ্যন্তরীণ উৎস—যেমন স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকেও ঋণ গ্রহণ করছে, অথচ সেই ঋণের পরিমাণ, সুদের হার বা শর্তাবলি জনসমক্ষে আসছে না।
বাস্তব উদাহরণ: সেনেগালের অভিজ্ঞতা
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ জানান, অস্বচ্ছ ঋণ পরিস্থিতির বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেছে আফ্রিকার দেশ সেনেগালে।
সেনেগালের স্বাধীন প্রশাসনিক আদালতের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশটির সরকারি ঋণের পরিমাণ মোট জিডিপির ৯৯.৬৭ শতাংশে পৌঁছেছে। অথচ পূর্ববর্তী সরকারের দাবি ছিল এর চেয়ে অন্তত এক চতুর্থাংশ কম।
এছাড়া, ২০২৫ সালের মার্চে সেনেগাল সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দলও অভিযোগ করে, দেশটির বাজেট ঘাটতি ও ঋণ বিষয়ে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে।
গোপন আলোচনা ও ঋণ পুনর্গঠন
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, কয়েকটি দেশ ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে নির্বাচিত কিছু ঋণদাতার সঙ্গে গোপন আলোচনায় লিপ্ত হয়েছে, যা সামগ্রিক ঋণ পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এমন অনিয়ম দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথেও বাধা সৃষ্টি করে।
বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট পাবলো সাভেদ্রা বলেন, “ঋণ স্বচ্ছতা শুধুমাত্র একটি কারিগরি দিক নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় কৌশলগত নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
তার ভাষায়, “এটি শুধু আর্থিক তথ্য প্রকাশ নয়, বরং নাগরিকদের প্রতি জবাবদিহিতার একটি দৃষ্টান্ত। স্বচ্ছতা বজায় থাকলে ঋণ সংগ্রহের খরচ কমে, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা কমে আসে।”
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত সংস্কার
বিশ্বব্যাংক স্বচ্ছ ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু সুস্পষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- ঋণ সংক্রান্ত আইনি কাঠামোতে সংস্কার:
ঋণ চুক্তি, শর্তাবলি, সুদের হার এবং মেয়াদ সংশ্লিষ্ট বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে। - ঋণ পুনর্মিলন প্রক্রিয়ায় সকল পক্ষের অংশগ্রহণ:
ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয়ের মধ্যে স্বচ্ছ আলোচনার মাধ্যমে চুক্তির শর্তাবলি নির্ধারণ করতে হবে। - নিয়মিত নিরীক্ষা ও তদারকি:
সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক তথ্য নিয়মিতভাবে নিরীক্ষা করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট জাতীয় সংস্থাগুলোর কার্যকর তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। - ঋণ পুনর্গঠনের পর তথ্য প্রকাশ:
ঋণের পুনর্গঠন বা চুক্তির সংশোধনের পর তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে, যেন জনগণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে তা মূল্যায়ন করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এ ধরনের প্রস্তাবনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হলে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঋণের বিস্তারিত তথ্য জনগণের সামনে উন্মুক্ত না থাকলে তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও দুর্বল করে। কারণ, বাজেট ঘাটতি, সুদ পরিশোধ ও ঋণ পরিশোধে জনগণের অর্থ ব্যয় হয়—সুতরাং জনগণের সেই তথ্য জানার পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
উপসংহার
বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিবেদন আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে, রাষ্ট্রীয় ঋণ শুধুমাত্র একক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়—বরং এটি একটি সর্বজনীন বিষয়। তাই ঋণের পরিমাণ, উৎস ও শর্তাবলির ওপর জনসচেতনতা তৈরি, নিয়মিত তথ্য প্রকাশ এবং স্বচ্ছতামূলক সংস্কার আজকের দিনে অত্যন্ত জরুরি।
সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একমাত্র স্বচ্ছ ঋণ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব। তা না হলে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা—উভয়ই অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে।