বাংলাদেশকেই প্রমাণ দিতে হবে—বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার লড়াই ও সম্ভাবনা

অর্থ ফেরত আনার লড়াইয়ে বাংলাদেশের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া শত শত কোটি টাকার সম্পদ বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। এই অর্থ ফিরিয়ে আনতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে এই বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি জানান, জব্দ করা সম্পদের উৎস যে বাংলাদেশি অর্থ, সেটি প্রমাণ করার দায়িত্ব একমাত্র বাংলাদেশেরই।
লন্ডন সফর: কেন গিয়েছিলেন গভর্নর মনসুর
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একটি সরকারি সফরে লন্ডনে গিয়েছিলেন। সফরের উদ্দেশ্য ছিল তিনটি:
- পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা
- বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা
- কারিগরি সহায়তার বিষয়ে ব্রিটিশ সংস্থার সঙ্গে কথাবার্তা
এই সফরে তিনি ব্রিটেনের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (NCA) এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-করাপশন কোঅর্ডিনেশন সেন্টারের (IACCC) সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার চ্যালেঞ্জ: তথ্যপ্রমাণ বাংলাদেশেরই দিতে হবে
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে কিছু বাংলাদেশির সম্পদ জব্দ করেছে। তবে সেগুলো যে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ দিয়ে অর্জিত—সেটি বাংলাদেশকেই প্রমাণ করতে হবে। যেমন, কেউ যদি বাংলাদেশ থেকে ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা বিদেশে নিয়ে গিয়ে সম্পদ কেনে, সেই অর্থের উৎস ও ব্যবহারযোগ্যতা স্বচ্ছভাবে তুলে ধরতে হবে।
উদাহরণ: বেক্সিমকোর নাম উল্লেখ
মনসুর বলেন, যেমন ধরুন—কোনো কোম্পানি বাংলাদেশে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, কিন্তু দেশে তার মাত্র ১০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে, বাকি টাকা কোথায় গেল? যদি দেখা যায়, সেই টাকা লন্ডনে সম্পত্তি কিনতে ব্যবহার হয়েছে, তাহলে স্পষ্ট বোঝা যাবে, এই অর্থের উৎস বাংলাদেশ।
বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ও সম্পদ: শুধু লন্ডনে নয়, কানাডা, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্রেও নজর
বাংলাদেশের পাচার হওয়া অর্থ শুধু লন্ডনেই সীমাবদ্ধ নয়। কানাডা, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রেও বিপুল সম্পদ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে এসব দেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে সরকার বদলের কারণে কিছুটা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
তদন্তে সমন্বয়হীনতা: বাংলাদেশের প্রধান দুর্বলতা
মনসুর খোলাখুলি বলেন, বিদেশি সহযোগিতা পেলেও বাংলাদেশের ভিতরের দুর্বলতা হলো প্রমাণ সংগ্রহ ও তদন্তে সমন্বয়হীনতা। বিএফআইইউ, সিআইডি, দুদক এবং এনবিআরের সিআইসি—এই চারটি সংস্থা আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে। একসঙ্গে বসে, তথ্য শেয়ার করে যৌথভাবে কাজ করার সংস্কৃতি নেই।
সমাধান হিসেবে যৌথ তদন্ত টিম গঠন
এই সমস্যা সমাধানে ‘জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম’ গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি, যুক্তরাজ্য সরকার ও বিশ্বব্যাংকের স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভ (StAR) থেকে কারিগরি সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
আইনি সহায়তা ও আন্তর্জাতিক ল ফার্ম: এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিক কোনো ল ফার্ম নিয়োগ দেয়নি, তবে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই ল ফার্মগুলো বিদেশি সম্পদের হদিস পেতে সাহায্য করতে পারবে, যা বাংলাদেশের সংস্থাগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়।
লিটিগেশন ফান্ডিং: নতুন উদ্যোগ
এখানে একটি নতুন পদ্ধতির কথা জানান গভর্নর—লিটিগেশন ফান্ডিং, যেখানে তৃতীয় কোনো পক্ষ মামলার খরচ দেবে। যদি মামলা জিতে অর্থ ফেরত আনা যায়, সেই প্রতিষ্ঠান লাভের একটি অংশ রাখবে। এতে সরকারের খরচ কমবে এবং মামলাগুলো আরও বাস্তবধর্মী হবে।
ক্রিমিনাল না সিভিল মামলা?—বাস্তবতা মেনে এগোনোর আহ্বান
মনসুর স্পষ্ট বলেন, সবকিছু নিয়ে ফৌজদারি (ক্রিমিনাল) মামলা করা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, বিদেশে এমন মামলা জেতা কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদী। তাই সিভিল মামলা বেশি করা হবে। যেখানে পর্যাপ্ত তথ্য নেই, সেখানে আর্থিক সমঝোতার মাধ্যমে সম্পদ ফেরত আনার পথ বেছে নেওয়া হবে।
রেমিট্যান্স বেড়েছে—পাচার কমেছে
রেমিট্যান্স প্রবাহ দেখে মনসুর বলেন, অর্থ পাচার কমেছে। হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিক পথে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা কমেছে বলেই বৈধ পথে পাঠানো অর্থ বেড়েছে। এটি পাচার রোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের প্রমাণ।
যেসব অর্থ ঠেকানো যাবে না—বাস্তবতা মেনে চলার পরামর্শ
মনসুর বলেন, সব পাচার ঠেকানো যাবে না। যেমন, কেউ যদি আইনসম্মতভাবে জমি বিক্রি করে বিদেশে বসবাসরত সন্তানকে টাকা পাঠান, সেটা ‘অবৈধ’ নয়। তাই এরকম অর্থ স্থানান্তরকে ‘পাচার’ বলা চলে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে।
ভবিষ্যতের করণীয়: আইন সংস্কার ও তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি
দুর্নীতির উৎস: রাজনীতি ও প্রশাসন
দুর্নীতির মূল উৎস হিসেবে মনসুর রাজনীতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেন। সাব-রেজিস্ট্রার, সিভিল সার্ভিস, পুলিশ প্রভৃতি খাতের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোটি কোটি টাকা আয় করছে, যা বিদেশে পাচার হচ্ছে।
প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী কৌশল
অর্থ পাচার রোধে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল, শক্তিশালী তদন্ত সংস্থা, আইনি সংস্কার, আন্তঃদেশীয় চুক্তি বাস্তবায়ন এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
অর্থ ফেরত আনার পথ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনার পথ সহজ নয়। তবে এটি অসম্ভবও নয়—যদি বাংলাদেশ প্রমাণ হাজির করতে পারে, তদন্তে পেশাদারিত্ব দেখায় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে।
এই যুদ্ধ শুধু অর্থ ফেরত আনার নয়, দেশের আস্থা ও সুনাম পুনঃস্থাপনেরও। তাই এটি হতে হবে রাজনৈতিক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার।