নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের বাজেট বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকা

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই বড় অঙ্কের বরাদ্দ রেখেছে। এর প্রায় ৯২ শতাংশই পরিচালন ব্যয়ে ব্যয় হবে বলে জানা গেছে।
বাজেটে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় ১৫৯ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে ইসির জন্য বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ অতিরিক্ত বরাদ্দ হয়েছে ১ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা।
কেন বাড়ানো হলো বরাদ্দ?
বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের জুনে। সেই সময়ের মধ্যে দেশের ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কমিশনের প্রশাসনিক, লজিস্টিক ও ম্যানেজমেন্ট ব্যয় বহুগুণে বাড়বে—তা বিবেচনা করেই এ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয় ও ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে ইসির জন্য ২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ে এবং ২২৯ কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
পরিচালন খরচে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ
নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ বৃদ্ধির বড় অংশটিই যাচ্ছে পরিচালন ব্যয় খাতে। গত বছরের তুলনায় এ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ২ হাজার ১১ কোটি টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে পরিচালন খাতে বরাদ্দ ছিল ৭১৬ কোটি টাকা, সেখানে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা।
এ ব্যয় প্রধানত ব্যালট ছাপানো, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) বা অন্যান্য সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা বাহিনীর মোতায়েন, ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং তদারকি কাজে ব্যয় করা হবে।
উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমেছে
আশ্চর্যজনকভাবে, পরিচালন খরচ বাড়লেও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমেছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল ৪২৬ কোটি টাকা, যা কমে আগামী বছর হয়েছে মাত্র ২২৯ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এবারের নির্বাচন যেহেতু বড় পরিসরে প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিবর্তে লোকবলনির্ভর হতে পারে, তাই উন্নয়ন খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে।
শেষ নির্বাচনে কত খরচ হয়েছিল?
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অন্তর্গত।
ওই নির্বাচনের জন্য ইসির বরাদ্দ ছিল মোট ৪ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা ছিল পরিচালন ব্যয়, এবং ২০৯ কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয়।
তুলনামূলকভাবে এবার প্রস্তাবিত বরাদ্দ কিছুটা কম হলেও তা সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুতিমূলক ব্যয় হিসেবে ধরা হচ্ছে।
বাজেট বক্তব্যে কোনো উল্লেখ ছিল না
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ চলতি সপ্তাহে জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করলেও নির্বাচন কমিশনের এই বরাদ্দ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে বাজেটের খাতভিত্তিক সংযুক্ত তালিকায় এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকায় সরকার বাজেট বক্তব্যে বিষয়টি উত্থাপন করেনি, তবে বরাদ্দ দিয়ে ভবিষ্যৎ নির্বাচনের প্রস্তুতির বার্তা স্পষ্টভাবে দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মত: স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ
নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক বললেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই অর্থ স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্যই ব্যয় করা হচ্ছে কি না—সেটিই গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আলী হায়দার বলেন,
“বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ভালো কথা, কিন্তু সেটি যেন কেবলমাত্র মেশিন কেনা বা ব্যালট ছাপানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। গণতান্ত্রিক মান নিশ্চিত করতে কমিশনের সাংগঠনিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাটাই জরুরি।”
নির্বাচনী বাজেট ব্যবহারে সতর্কতা জরুরি
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন,
“যত বড় বরাদ্দই দেওয়া হোক, যদি তার যথাযথ ব্যবহার না হয়, তাহলে সেটি জনগণের ট্যাক্সের অপচয়। ইসি যদি স্বাধীনভাবে কার্যক্রম চালাতে পারে, তাহলে এই বাজেট যৌক্তিক। নইলে এটি কেবল নির্বাচন আয়োজনের ছদ্মাবরণে খরচ।”
নির্বাচনের গতি প্রকৃতির দিকেই তাকিয়ে দেশ
এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আগামী নির্বাচন। বরাদ্দের অঙ্ক বড় হলেও প্রশ্ন হচ্ছে—এই অর্থ কী সত্যিকার অর্থে একটি স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য ব্যবহার হবে?
জনগণ, রাজনৈতিক দল এবং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এখন নির্বাচন কমিশনের কার্যকর পদক্ষেপ ও প্রস্তুতির ওপর।