বিশ্ব

৯/১১ হামলায় সহায়তার অভিযোগে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মামলা চলবে

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা আজও বিশ্ববাসীর মনে আতঙ্কের স্মৃতি হয়ে আছে। এই হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ও ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে, যার ফলে প্রায় ৩,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়। এই ঘটনা শুধু আমেরিকান ইতিহাসেই নয়, গোটা বিশ্বেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেহারা বদলে দেয়। আর সেই ঘটনার প্রায় ২৪ বছর পর, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি নিয়ে বড় একটি রায় দিয়েছেন মার্কিন আদালত।

সম্প্রতি নিউইয়র্কের একজন ফেডারেল বিচারক ঘোষণা দিয়েছেন যে, ৯/১১ হামলায় নিহতদের পরিবার সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে, সেটি চলবে। সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে মামলাটি খারিজের আবেদন জানানো হলেও আদালত তা নাকচ করে দিয়েছেন।

রায়ের বিস্তারিত

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারক জর্জ ড্যানিয়েলস বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট ২০২৫) এই গুরুত্বপূর্ণ রায় দেন। তাঁর মতে, বাদীপক্ষ যে অভিযোগ এবং প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করেছে, তা মামলাটি চলার জন্য যথেষ্ট। অর্থাৎ, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ৯/১১ হামলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ আদালতে খারিজ হয়নি।

জজ ড্যানিয়েলস তাঁর রায়ে উল্লেখ করেন, সৌদি সরকারের যে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিল মামলাটি খারিজের পক্ষে, তা যথেষ্ট শক্তিশালী বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে সেই যুক্তি পরস্পরবিরোধী। এর ফলে মামলার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

বাদীপক্ষের অভিযোগ কী?

বাদীপক্ষের আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, সৌদি আরব ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ হামলার আগে সন্ত্রাসীদের সহায়তা করেছিল। তাদের দাবি, সৌদি আরবের উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ছিলেন এবং তাঁরা আল-কায়েদার সঙ্গে জড়িত চরমপন্থীদের সহায়তা করেছিলেন।

বিশেষ করে দুই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়— ওমর আল-বায়ুমি এবং ফাহাদ আল-থুমাইরি। বাদীপক্ষের দাবি, এই দুই ব্যক্তি সৌদি সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন এবং সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিলেন।

ওমর আল-বায়ুমিকে মূলত একজন সৌদি সরকারি এজেন্ট হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আল-কায়েদা সদস্যদের বাসস্থানের ব্যবস্থা, অর্থ সহায়তা এবং নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিলেন। একইভাবে, ফাহাদ আল-থুমাইরি একজন কূটনৈতিক পদে ছিলেন এবং তাঁরও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগ রয়েছে।

সৌদি আরবের অবস্থান

অন্যদিকে সৌদি সরকার বারবার দাবি করে আসছে যে, তাদের সঙ্গে ৯/১১ হামলার কোনো সম্পর্ক নেই। তারা বলছে, সৌদি আরব সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিল এবং রয়েছে। এমনকি ২০০১ সালের ঘটনার পর সৌদি আরব আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র হিসেবে কাজ করেছে।

তবে নিহতদের পরিবারের দাবি, সৌদি সরকার যে সহযোগিতা করেছে, তা গোপন ছিল এবং সরাসরি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নয় বরং গোপন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এই কারণেই মামলাটি এখনো জটিল এবং দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

৯/১১ হামলার পটভূমি

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে নিউইয়র্ক সিটির ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর টাওয়ারে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১১ আঘাত হানে। এর কিছুক্ষণ পর, সকাল ৯টা ০৩ মিনিটে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১৭৫ দক্ষিণ টাওয়ারে আঘাত হানে। এরপর পেন্টাগনে আরেকটি বিমান আঘাত হানে এবং চতুর্থ বিমানটি পেনসিলভানিয়ার শ্যাংক্সভিলে বিধ্বস্ত হয়।

এই ভয়াবহ হামলায় প্রায় ৩,০০০ মানুষ নিহত হয় এবং ৬,০০০-এর বেশি মানুষ আহত হয়। হামলার দায় স্বীকার করে সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা। সংগঠনটির নেতা ওসামা বিন লাদেন এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন।

আইনি লড়াইয়ের ইতিহাস

এই মামলা নতুন কিছু নয়। ৯/১১ হামলার পরপরই নিহতদের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তরা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব রাষ্ট্রীয় ইমিউনিটির কথা বলে এই মামলাটি খারিজ করার চেষ্টা করে আসছিল।

২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে Justice Against Sponsors of Terrorism Act (JASTA) পাস হয়। এই আইনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা বিদেশি সরকারকে মার্কিন আদালতে দায়ী করা সম্ভব হয়। এর পর থেকেই মামলাটি আবার গতি পায়।

মামলার বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ

এখন প্রশ্ন হলো, আদালতের এই রায়ের পর কী হবে? মামলাটি এখন পূর্ণাঙ্গ শুনানির পর্যায়ে যাবে। বাদীপক্ষ সৌদি আরবের বিরুদ্ধে প্রমাণ উপস্থাপন করবে, আর সৌদি সরকার তা খণ্ডন করবে। আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মামলা শেষ হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।

যদি আদালত শেষ পর্যন্ত রায় দেয় যে, সৌদি আরব সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ৯/১১ হামলায় জড়িত ছিল, তবে এর প্রভাব আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্ক তখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য

অনেক আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, মামলাটি শুধুমাত্র আইনি বিষয় নয়, বরং এটি কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরও বড় প্রভাব ফেলবে। কারণ সৌদি আরব বিশ্বের অন্যতম তেল উৎপাদনকারী দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম কৌশলগত মিত্র।

অন্যদিকে, নিহতদের পরিবার মনে করছেন, এই রায় তাদের জন্য ন্যায়বিচারের পথে বড় পদক্ষেপ। তাঁদের মতে, ২৪ বছর পর হলেও সত্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

৯/১১ হামলা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যই একটি শিক্ষা। এই মামলার চূড়ান্ত ফলাফল যাই হোক না কেন, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

MAH – 12543 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button