আঞ্চলিক

নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন

নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর, সোনাইমুড়ী ও বেগমগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা এখন হাইব্রিড ধান চাষ থেকে সরে এসে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ধান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কারণ হিসেবে কৃষকেরা বলছেন—হাইব্রিড ধানের ঝুঁকি, উচ্চ খরচ, রোগবালাই এবং বীজের ওপর নির্ভরশীলতা তাদেরকে বাধ্য করছে বিকল্প পথ বেছে নিতে। আর সেই বিকল্প পথ এখন ব্রি উদ্ভাবিত ধান।

ব্রি-৭৪: মোস্তফার সাফল্য

সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটার কৃষক মো. মোস্তফা এবার দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন। এই জাত থেকে তিনি প্রতি হেক্টরে ৯.২৩ মেট্রিক টন ফলন পেয়েছেন, যা বাজারে প্রচলিত হাইব্রিড জাতের চেয়েও বেশি। সবচেয়ে বড় বিষয়, এই ধান থেকে তিনি নিজেই বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন, যা হাইব্রিড ধানের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।

মোস্তফা বলেন, “আগে হাইব্রিড চাষ করতাম, কিন্তু প্রতিবার নতুন করে বীজ কিনতে হতো, খরচ বেশি, ঝুঁকিও বেশি। এখন ব্রি ধান চাষ করে দেখলাম ফলন বেশি, রোগবালাই কম, আবার নিজেই বীজ রাখতে পারি। ভবিষ্যতে আরও বেশি জমিতে এই ধান চাষ করব।”

ব্রি-৯২: লাভের মুখ দেখলেন ওমর ফারুক

একই এলাকার কৃষক ওমর ফারুক দুই একর জমিতে চাষ করেছেন ব্রি-৯২ জাতের ধান। খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। তিনি বলছেন, প্রতি একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ, যার বাজারমূল্য প্রায় দেড় লাখ টাকা। তিনি ধানের কিছু অংশ নিজে বীজ হিসেবে রেখে বাকিটা বিক্রি করে আয় করার পরিকল্পনা করছেন। ইতিমধ্যে আশপাশের কৃষকেরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এই বীজ সংগ্রহের জন্য।

ব্রি-১০৫: পুষ্টির পাশাপাশি ভালো ফলন

সুবর্ণচরের মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক দম্পতি মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন এবার চাষ করেছেন ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য উপযোগী ব্রি-১০৫ জাতের ধান। হেক্টরপ্রতি ফলন পেয়েছেন ৮.২ মেট্রিক টন। এই জাতটিও ব্রির উদ্ভাবিত এবং বীজ সংরক্ষণের উপযোগী।

কেন বাড়ছে হাইব্রিড থেকে বিমুখতা?

নোয়াখালী অঞ্চলের কৃষকেরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির হাইব্রিড ধানবীজ ব্যবহার করতেন। এসব বীজের দাম কেজিপ্রতি ৩৫০-৫০০ টাকা এবং একরপ্রতি প্রয়োজন হয় প্রায় ৬ কেজি বীজ। ফলে শুধুমাত্র বীজের পেছনেই কৃষকের খরচ দাঁড়ায় হাজার টাকার বেশি।

অন্যদিকে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী জাতের ধানবীজের দাম ৫০-১০০ টাকা কেজি, আর একরপ্রতি প্রয়োজন হয় ১০ কেজি বীজ। খরচ কিছুটা বেশি হলেও এই জাতের ফলন প্রায় ৭০-৭৫ মণ প্রতি একরে। সেই সঙ্গে কৃষকেরা নিজেরাই বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন, যা বারবার নতুন বীজ কেনার প্রয়োজন কমিয়ে দেয়।

হাইব্রিড ধানের ক্ষেত্রে রোগবালাইয়ের প্রকোপ বেশি হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে ব্রি ধানের জাতগুলো রোগ প্রতিরোধী হওয়ায় কৃষকেরা কম খরচে নিরাপদ ফলন পাচ্ছেন।

সরকারিভাবে প্রদর্শনী খামার ও সহযোগিতা

বোরো মৌসুমে নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মোট ৪৯০টি প্রদর্শনী খামারে ব্রি উদ্ভাবিত ৮টি জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও তাদের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা এর তত্ত্বাবধানে এসব প্রদর্শনী বাস্তবায়িত হয়।

এই প্রকল্পের কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক বলেন, “নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক আগে শুধু হাইব্রিড বীজের ওপর নির্ভর করতেন। কিন্তু এখন তাঁরা ব্রির জাত চাষে আগ্রহী হচ্ছেন, কারণ এতে রোগবালাই কম, ফলন ভালো এবং নিজেরা বীজ রাখতে পারছেন।”

কৃষি অধিদপ্তরের মন্তব্য

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ বলেন, “ব্রি উদ্ভাবিত ধানগুলো শুধু উচ্চফলনশীল নয়, বরং পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ। এগুলো চাষে কৃষকের খরচ কমছে, পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে এবং বীজ নিয়ে আর কোনো নির্ভরতা থাকছে না।”

ব্রির গবেষণার নতুন দিগন্ত

ফেনীর সোনাগাজীতে অবস্থিত ব্রি আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান বলেন, “আমরা এখন আর শুধু ফলন বৃদ্ধির কথা ভাবি না, ভাবি পুষ্টির কথাও। নতুন যে জাতগুলো উদ্ভাবন করছি, সেখানে জিংক, আয়রন, ভিটামিন—এসব পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি আরও বলেন, “যেহেতু ভাত আমাদের প্রধান খাবার, তাই যদি ভাত থেকেই পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে আলাদাভাবে মাছ, মাংস বা ফল কিনে খাওয়ার চাপও কিছুটা কমবে।”

কৃষকের হাতে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি

নোয়াখালীর কৃষকেরা এখন ধীরে ধীরে হাইব্রিড ধানের একচেটিয়া বাজার থেকে বেরিয়ে আসছেন। ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো শুধুমাত্র কৃষকের লাভ নিশ্চিত করছে না, বরং পুষ্টিসমৃদ্ধ ধান উৎপাদনের মাধ্যমে সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সহায়ক হচ্ছে। কৃষকেরা নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছেন বীজ সংরক্ষণের ক্ষমতার মাধ্যমে, যা একটি দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তুলছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button