রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির সামনে বৃহস্পতিবার দুপুরে ভিন্ন এক চিত্র দেখা গেল। অফিসগামী, দিনমজুর, গৃহিণী—সব শ্রেণির মানুষ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন একটি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের পেছনে। ট্রাকটি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি), যেখানে কম দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল ও চিনি।
এই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী নাজিম হোসেন। ভদ্রলোক নিজেই স্বীকার করলেন—“আয় একই আছে, কিন্তু বাজারের খরচ হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। বাধ্য হয়েই ট্রাকের পেছনে দাঁড়াতে হয়েছে। চিন্তা হয়, যদি কোনো পরিচিত দেখে ফেলে! তবুও সংসারের খরচ চালাতে হলে লজ্জার ভ্রূকুটি গিলেই দাঁড়াতে হবে।”
নাজিমের মতো মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের অসংখ্য মানুষ এখন টিসিবি কিংবা খাদ্য অধিদপ্তরের খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচির ট্রাকের দিকে ঝুঁকছেন।
টিসিবি ও ওএমএস ট্রাকে কী পাওয়া যায়?
টিসিবির প্রতিটি ট্রাকে ৫০০ জনের জন্য পণ্য বরাদ্দ থাকে। একজন গ্রাহক কিনতে পারেন—
- ২ লিটার সয়াবিন তেল
- ২ কেজি মসুর ডাল
- ১ কেজি চিনি
মোট খরচ: ৪৫০ টাকা
বাজারে একই জিনিস কিনতে লাগে প্রায় ৬২০–৬৫০ টাকা।
অন্যদিকে, ওএমএস ট্রাকে ৩০০ জনের জন্য চাল ও ৫০০ জনের জন্য আটা সরবরাহ করা হয়। একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ কিনতে পারেন—
- ৫ কেজি চাল
- ৪ কেজি আটা
মোট খরচ: ২৬০ টাকা
বাজারে একই জিনিস কিনতে হলে লাগে প্রায় ৫০০ টাকা।
বাজারে নিত্যপণ্যের অস্থিরতা
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে— গত তিন মাসে সবজির দাম বেড়েছে সর্বনিম্ন ১৬% থেকে সর্বোচ্চ ৭৫% পর্যন্ত।
বর্তমানে বাজারে—
- বেগুন, ঢ্যাঁড়স, কচুর লতি, পটোল, করলা, কাঁকরোল—সব কিছুর দাম ৬০–৮০ টাকার ওপরে।
- এক ডজন ডিম ১৩০–১৪০ টাকা, মহল্লাভেদে আরও বেশি।
- ব্রয়লার মুরগি কেজি প্রতি ১৮০ টাকা, সোনালি মুরগি ২৯০–৩২০ টাকা।
- মাছের দাম ২৮০ টাকার নিচে নামছেই না।
- আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ৫–১০ টাকা।
- মসুর ডালের দাম কেজি প্রতি প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে।
এই দামে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
লম্বা লাইনের অভিজ্ঞতা
মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, লালমাটিয়া, খামারবাড়ি থেকে শুরু করে কারওয়ান বাজার—সবখানেই একই দৃশ্য। কোথাও শতাধিক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন, আবার কোথাও দীর্ঘ অপেক্ষার পরও অনেকে খালি হাতে ফিরছেন।
যেমন, মো. নাজমুল ইসলাম নামে এক কর্মজীবী লালমাটিয়ায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও পণ্য না পেয়ে ফিরে যান। তিনি বলেন—“কাজের ফাঁকে এসেছিলাম। সময় বেশি লাগায় আর দাঁড়ানো সম্ভব হলো না।”
কেন হঠাৎ দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেল?
অর্থনীতিবিদদের মতে, কয়েকটি কারণে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে—
- বর্ষা মৌসুমে সরবরাহ কম → মাঠ থেকে পর্যাপ্ত সবজি আসছে না।
- বৈশ্বিক বাজারের প্রভাব → আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, ডাল ও গমের দাম বৃদ্ধি।
- ডলার সংকট → আমদানির খরচ বেড়েছে।
- অভ্যন্তরীণ মজুতদারি → অসাধু ব্যবসায়ীরা মজুত করে দাম বাড়াচ্ছে।
- পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি → জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব।
সরকারের উদ্যোগ
সরকার ইতিমধ্যে টিসিবি ও ওএমএস কর্মসূচি বাড়িয়েছে। প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শত শত ট্রাকে বিক্রি চলছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সুপারিশ করেছে—
- এক ডজন ডিমের দাম ১৫০ টাকা ছাড়ালে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া।
- এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৯০ টাকা ছাড়ালে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া।
- এসব পণ্যে শুল্ক-কর কমানোরও প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
মানুষের মুখে মানুষের কথা
গৃহিণী সেলিনা বেগম বলেন—“মাসের শুরুতেই পুরো বাজেট গড়িয়ে যায়। বাজারে গেলে মনে হয় জিনিসপত্রের কোনো দামই হাতের নাগালে নেই। টিসিবির ট্রাকে দাঁড়িয়েই বাঁচছি।”
দিনমজুর রহিম উদ্দিন বলেন—“আমাদের মতো মানুষ যদি সরকারি ট্রাক না পেতাম, তাহলে তো না খেয়ে থাকতে হতো।”
এক বেসরকারি শিক্ষক হাসানুল কবিরের মন্তব্য—“আগে আমরা মধ্যবিত্ত ছিলাম, এখন নীচে নেমে যাচ্ছি। আজকাল ট্রাকের পেছনে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই।”
দীর্ঘমেয়াদে কী করা প্রয়োজন?
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
- কৃষিপণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানো।
- সঠিক সময়ে আমদানি সিদ্ধান্ত নেওয়া।
- বাজার মনিটরিং জোরদার করা।
- মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
- খাদ্যে ভর্তুকি ও সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করা।
আজকের বাস্তবতা হলো— বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন আয়ের সবার ঘাড়ে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। হয়তো কারও কাছে এটি লজ্জার, আবার কারও কাছে বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা।
সরকারি উদ্যোগ দ্রুত, কার্যকর ও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন না হলে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। তবে আশার আলো হচ্ছে— টিসিবি ও ওএমএসের এই ট্রাকসেল কার্যক্রম অন্তত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছুটা স্বস্তি এনে দিচ্ছে।
MAH – 12644, Signalbd.com



