বাংলাদেশ

ডেঙ্গুতে একদিনে আরও ১ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩৮৩ জন

বাংলাদেশে এডিস মশাবাহিত মারাত্মক রোগ ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৩৮৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এই তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম।

ডেঙ্গু রোগ বর্তমানে বাংলাদেশে একটি জটিল স্বাস্থ্য সংকটের রূপ নিয়েছে। বিশেষত বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হওয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ ১৩৬ জন বরিশালের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ঢাকা শহরের দুই সিটিতে ৬০ জন, ঢাকা বিভাগের অন্য এলাকায় (সিটি করপোরেশন বাদে) ৪৮ জন, খুলনা বিভাগে ৪১ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৫ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।

সাম্প্রতিক ডেঙ্গু সংক্রমণের পরিসংখ্যান

২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ২৩ জন পুরুষ ও ১৯ জন নারী রয়েছেন। এছাড়া এই বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯,৮৬৭ জনে। এর মধ্যে ৫,৮২৫ জন পুরুষ ও ৪,০৪২ জন নারী।

ডেঙ্গু রোগের প্রকৃতি এবং বিস্তার

ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশা বহন করে মানুষের শরীরে ছড়ায়। ডেঙ্গু রোগ সাধারণত উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরের ব্যথা, চোখের পেছনের ব্যথা, ত্বকে দাগ ও ফুসকুড়ি ইত্যাদি উপসর্গ সৃষ্টি করে। গুরুতর অবস্থায় ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রূপ নিতে পারে, যা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ডেঙ্গু বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়মিত মশক নিধন অভিযান চালাচ্ছে। তবে নাগরিকদের সচেতনতা ও নিজ নিজ বাড়ি ও আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারের পদক্ষেপ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি

সরকার ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জেলায় মশক নিধন ও জনস্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচি চালাচ্ছে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিশেষ টিম নিয়োগ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ চিনতে ও প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে।

সচেতনতা বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধে জনগণকে নিয়মিত বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, মশার লার্ভা ধ্বংস করা, প্লাস্টিক বর্জ্য কমানো ও রেডি-টু-ইউ পানি সংরক্ষণে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রোধে করণীয়

১. বাড়ির আশপাশের সব নোংরা জল জমে থাকা বন্ধ করতে হবে।
২. টিউব, ময়লা বালতি, ফুলের গামলা, পাত্র, ড্রেন যেখানে জল জমে মশার লার্ভা থাকে, সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
৩. মশারোধী ক্রীম বা স্প্রে ব্যবহার করতে হবে।
৪. রাতে শুতে গেলে মশারি ব্যবহার করা উচিত।
৫. জ্বর বা ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ ডাঃ সায়মা আক্তার বলেন, “বর্তমান আবহাওয়া ডেঙ্গু মশার বিস্তারে সহায়ক। তাই প্রত্যেককে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের সময়মতো চিকিৎসা না নিলে জটিলতা বাড়তে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও সচেতনতা জরুরি। মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণ করাই একমাত্র কার্যকর সমাধান।”

ডেঙ্গু: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংকট

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, ডেঙ্গু হল বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। প্রায় ১১০টি দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন, যার মধ্যে প্রায় ৪০০০ জনের মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশে বর্ষাকালে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়, কারণ এডিস মশার লার্ভা গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রযুক্তি ও গবেষণা

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভ্যাকসিন উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। কিছু দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ভ্যাকসিন ব্যবহৃত হলেও এখনও ব্যাপক ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়নি। বাংলাদেশেও এই গবেষণা চলছে। পাশাপাশি ডেঙ্গু শনাক্তকরণে দ্রুত পরীক্ষার কিট ব্যবহার শুরু হয়েছে, যা রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করছে।

ডেঙ্গু মোকাবিলায় নাগরিকদের ভূমিকা

ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকের সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, জমে থাকা জল নিষ্কাশন, মশারোধী ব্যবস্থা গ্রহণ ও রোগীকে দ্রুত চিকিৎসা দেয়ার মাধ্যমে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করা সম্ভব।

ডেঙ্গু একটি মারাত্মক ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোগ। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সবাইকে আরও বেশি সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর হার যাতে আর বাড়ে না, তা নিশ্চিত করতে সরকারি কার্যক্রম ও জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button