ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে তেলের দাম বাড়লো, জ্বালানি সংকটের শঙ্কা

গত ১২ জুন রাত তিনটার দিকে ইরানে ইসরায়েলের হামলার পর একদিনের মধ্যেই মালয়েশিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩৪,৬১৭ টন ডিজেল নিয়ে আসা একটি জাহাজ পৌঁছায়। কিন্তু সেই এক জাহাজে তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারের খরচ প্রায় ৬৮ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দামবৃদ্ধির প্রভাব সামগ্রিকভাবে দেশের জ্বালানি খাত ও সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার পেছনের কারণ
বিশ্বব্যাপী তেলের দাম নির্ধারণ হয় মূলত দুইটি প্রধান বাজার সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রের ভিত্তিতে। বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সিঙ্গাপুরের আন্তর্জাতিক ‘প্ল্যাটস’ সংস্থার দর অনুযায়ী তেল কেনে। প্ল্যাটসের নিয়ম অনুযায়ী, জাহাজে তেল লোডের দিন ও তার চারপাশের চার দিন—মোট পাঁচ দিনের দাম গড়ে বিপিসি তেল কিনে।
১৩ জুন যখন এমটি পিভিটি আভিরাতে জাহাজে ডিজেল ভর্তি করা হয়, তখন থেকে তেলের দাম ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। এর আগে ১১ জুন ডিজেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৭৯.২৪ ডলার, যা ১৩ জুন বাড়ে ৮৫ ডলার এবং ১৬-১৭ জুন দাঁড়ায় ৮৬.৭৮-৮৬.৭৯ ডলারে।
তেলের আমদানিতে অতিরিক্ত ব্যয়
বিপিসি সূত্র জানায়, ৩৪,৬১৭ টন বা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৯৪৯ ব্যারেল ডিজেলের দাম পাঁচ দিনের গড় ভিত্তিতে পরিশোধ করতে হয়েছে ৮৩.৮৪ ডলার প্রতি ব্যারেল হিসেবে, যার মোট মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২ কোটি ১৬ লাখ ডলার বা প্রায় ২৬৫ কোটি টাকা। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের আগে এই পরিমাণ ডিজেলের জন্য খরচ হতো মাত্র ১৯৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ এক জাহাজে ৬৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে।
সংঘাতের আগে ও পরে ডিজেলের দাম তুলনা
সংঘাত শুরু হওয়ার আগের মাসে (২ জুন) ডিজেলের দাম ছিল প্রায় ৭৬.৬৯ ডলার প্রতি ব্যারেল। কিন্তু সংঘাতের কারণে ১৩ জুন থেকে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩.৮৪ ডলারে, যা প্রায় ৭ দশমিক ১৫ ডলার বা প্রতি ব্যারেলে প্রায় ৯ শতাংশ বৃদ্ধি।
বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
ডিজেল বাংলাদেশে কৃষি, শিল্প ও পরিবহন খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জ্বালানি তেল। ডিজেলের দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়, যার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
বিশ্ববাজারে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে তেলের দাম আরও বাড়তে পারে বলে বিপিসির বাণিজ্য বিভাগ আশঙ্কা করছে। বর্তমানে ডিজেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ৮২ থেকে ৯৩ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে, যা আগামী দিনে ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বিপিসির করণীয় এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বিপিসির পরিচালক এ কে এম আজাদুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, “বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে, তাই আমাদের আমদানি খরচও বেড়ে যাচ্ছে। এটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।” তিনি আরও বলেন, “আমরা নিয়মিত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি এবং দাম বৃদ্ধি মোকাবিলায় নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের চেষ্টা করছি।”
তেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সরকারের করণীয়
বাংলাদেশের সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখন প্রয়োজন তেলের আমদানিতে বৈচিত্র্য আনয়নের পাশাপাশি বিকল্প জ্বালানি উৎস এবং শক্তি নিরাপত্তায় গুরুত্বারোপ করা। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় দেশের জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির পেছনের বৈশ্বিক প্রেক্ষিত
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তেল সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। বিশ্বজুড়ে তেলের প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতে উত্তেজনা থাকায় উৎপাদন কমে গেছে। ফলে সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তেলের দাম দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশে তেলের আমদানি ব্যয় বাড়ছে।
সংক্ষেপে:
- ১২ জুন ইরানে ইসরায়েলের হামলার পর ডিজেলের দাম দ্রুত বেড়ে যায়।
- ১৩ জুন থেকে ৩৪,৬১৭ টন ডিজেল নিয়ে আসা জাহাজে ৬৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে।
- বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় বাংলাদেশের আমদানিতে চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- ডিজেল দেশের কৃষি ও শিল্পে প্রধান জ্বালানি, যার দাম বাড়লে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
- হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা।
- বিপিসি ও সরকার বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
সামগ্রিক প্রভাব ও পরামর্শ
তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে জীবিকা ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই সরকারের প্রয়োজন শক্তি নীতিমালা পুনর্বিবেচনা ও পরিবেশ বান্ধব বিকল্প শক্তির ওপর বেশি জোর দেয়া। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রভাবশালী পরিস্থিতি মোকাবিলায় কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি।