বিশ্ব

নেতানিয়াহুর অনুমতির পর অবশেষে গাজার দিকে ত্রাণ প্রবেশের ক্ষীণ আশার আলো

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে সামান্য পরিমাণে হলেও গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিল ইসরায়েল। তীব্র আন্তর্জাতিক চাপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনার মুখে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রোববার (১৮ মে) ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, গাজা উপত্যকায় মানবিক দুর্ভিক্ষ এড়াতে সীমিত আকারে ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত এই ত্রাণ প্রবেশ কবে এবং কী পরিমাণে কার্যকর হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।

মানবিক বিপর্যয়ের মুখে গাজা

গত মার্চের শুরু থেকে গাজার প্রবেশদ্বারগুলো বন্ধ রাখে ইসরায়েল। ফলে টানা আড়াই মাস ধরে গাজার ভেতরে কোনো ধরনের খাদ্য, ওষুধ বা নিত্যপ্রয়োজনীয় ত্রাণ পৌঁছায়নি। এর ফলে বিশেষ করে উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং শিশুদের মধ্যে মারাত্মক অপুষ্টিজনিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫৭ জন, যাদের অধিকাংশই শিশু। মানবিক সংগঠনগুলো গাজায় ত্রাণ অবরোধকে ‘বিধ্বংসী অবরোধ’ (siege warfare) আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কথাও বলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই কি সিদ্ধান্ত?

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনার মুখে পড়ে নেতানিয়াহুর সরকার এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। গত সপ্তাহেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক গোপন বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষ্কার জানান, গাজার পরিস্থিতি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মানবিক বিপর্যয় বিশ্বজনমতকে সম্পূর্ণভাবে তাদের বিপক্ষে নিয়ে যেতে পারে।

এরই প্রেক্ষিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নতুন সামরিক অভিযান ‘গিডিয়নস চ্যারিয়ট’-এর অগ্রগতির জন্য ত্রাণ প্রবেশকে ‘কৌশলগত প্রয়োজন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সামরিক বিভাগের মতে, ত্রাণ সরবরাহের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমিত করে গাজায় সামরিক অভিযান চালানো আরও সহজ হবে।

“গিডিয়নস চ্যারিয়ট”: নতুন অভিযানে লক্ষ্য কি?

ইসরায়েলি বাহিনী চলমান ‘গিডিয়নস চ্যারিয়ট’ অভিযানে গাজার মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের অবশিষ্ট ঘাঁটি ধ্বংস করতে তৎপর। সূত্র মতে, ইসরায়েল দক্ষিণ গাজার রাফা শহরের আশপাশে স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, রাফায় অভিযানের ফলে আরও বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হতে পারেন, বিশেষ করে যারা ইতোমধ্যেই গৃহহীন হয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিক্রিয়া

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বহু আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসরায়েলের ‘দুর্ভিক্ষকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার’ করার প্রবণতা নিয়ে আগে থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছিল। এখন তারা বলছে, এই সীমিত ত্রাণ প্রবেশ ‘অত্যন্ত দেরিতে নেওয়া ক্ষীণ পদক্ষেপ’, যা মূলত আন্তর্জাতিক ক্ষোভ প্রশমনের কৌশল।

ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষ এবং হামাস উভয়েই এই ত্রাণ অনুমতির সিদ্ধান্তকে ‘প্রচারমূলক’ ও ‘চোখে ধুলা দেওয়ার চেষ্টা’ বলে অভিহিত করেছে। তাদের দাবি, অবিলম্বে পূর্ণমাত্রায় ত্রাণ প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং সকল রকম মানবিক বাধা তুলে নিতে হবে।

মিশর ও কাতারের কূটনৈতিক তৎপরতা

গাজায় ত্রাণ প্রবেশ ও যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে মিশর ও কাতার দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যস্থতার চেষ্টা করে আসছে। কায়রো সূত্রে জানা গেছে, গাজা সংকট নিরসনে নতুন করে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের আয়োজন করা হতে পারে, যেখানে ইসরায়েল, হামাস এবং যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেবে।

এছাড়া, আন্তর্জাতিক আদালতের একাধিক মামলায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ বিচারাধীন রয়েছে, যার অন্যতম কারণ এই ত্রাণ অবরোধ।

সংকটের মাঝেও আশার ক্ষীণ রেখা

গাজায় ত্রাণ প্রবেশের এই ঘোষণাকে বিশ্লেষকরা সংকট সমাধানের কোনো স্থায়ী সমাধান হিসেবে না দেখলেও, একে আশার ক্ষীণ আলোকরেখা হিসেবে গণ্য করছেন। তবে বাস্তবতায় এই ত্রাণ ঠিক কতটা দ্রুত পৌঁছাবে, কী পরিমাণে পৌঁছাবে, এবং তা সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাবে কিনা— তা নিয়েই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button