পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির পর শ্রীনগরে ফের বিস্ফোরণ, ব্ল্যাক আউট

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারত-শাসিত কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এই ঘটনার পর শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যা বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আল জাজিরার প্রতিবেদনের বরাতে জানা গেছে, শনিবার (১০ মে) বিকেল ৫টা থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও রাতে শ্রীনগরে এই বিস্ফোরণগুলো শান্তির প্রত্যাশাকে ম্লান করে দিয়েছে।
বিস্ফোরণ ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা: শ্রীনগরে আতঙ্ক
শ্রীনগরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে জোরালো বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা মাদিহা ফারুক আল জাজিরাকে বলেন, “যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর আমরা স্বস্তি অনুভব করছিলাম। আমাদের বড় পরিবার একত্রিত হয়ে চা খাচ্ছিল। হঠাৎ জোরালো বিস্ফোরণে আশপাশ কেঁপে ওঠে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে আলো নিভিয়ে এক কোণে জড়ো হই।”
অন্য এক বাসিন্দা জানান, একটি বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে দেয়াল কেঁপে উঠেছিল। তিনি বলেন, “কর্তৃপক্ষ কী ঘটছে তা স্পষ্ট করছে না। আমাদের কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই, কোনো সাইরেনও শুনিনি। আমরা কী করব জানি না।” এই ঘটনার পর শহরের একাধিক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
স্থানীয় মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “শ্রীনগরজুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।” তবে তিনি এর কারণ বা প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি। সাংবাদিক ওমর মেহরাজও বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন, তবে এটি ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরণ কিনা তা নিশ্চিত করতে পারেননি।
যুদ্ধবিরতির পটভূমি
শনিবার বিকেলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশাল প্ল্যাটফর্মে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তিনি বলেন, “গত রাতে ভারত ও পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলার পর তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।” ট্রাম্প উভয় দেশের নেতৃত্বের বিচক্ষণতার প্রশংসা করেন। পরে ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
এই যুদ্ধবিরতি ভারত-শাসিত কাশ্মীরে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা ও সংঘাতের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। ২০১৯ সালে ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর থেকে এই অঞ্চলে উত্তেজনা বেড়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে প্রায়শই সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
বাসিন্দাদের উপর প্রভাব
শ্রীনগরের সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ বাসিন্দাদের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে দিয়েছে। মাদিহা ফারুকের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা স্বল্প সময়ের জন্য স্বস্তি এনেছিল, কিন্তু বিস্ফোরণ সেই আশাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে, কারণ অন্ধকারে বাসিন্দারা তথ্যের অভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন।
স্থানীয় একজন শিক্ষক, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিগন্যালবিডিকে বলেন, “আমরা সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকি। যুদ্ধবিরতির খবরে আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো কিছুদিন শান্তিতে থাকতে পারব। কিন্তু এই বিস্ফোরণ আমাদের আবার সেই আতঙ্কের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।” তিনি আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বার্তা না থাকায় মানুষের মধ্যে গুজব ছড়াচ্ছে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর ইস্যু দীর্ঘদিন ধরে একটি জটিল সমস্যা। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভাজনের পর থেকে এই অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধবিরতি একটি কূটনৈতিক অগ্রগতি হলেও, শ্রীনগরের বিস্ফোরণ এই প্রক্রিয়ার ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে।
দিল্লিভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. রাহুল শর্মা বলেন, “যুদ্ধবিরতি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু কাশ্মীরের স্থানীয় পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল। এই বিস্ফোরণগুলো স্থানীয় জঙ্গি গোষ্ঠী বা অন্য কোনো পক্ষের কাজ হতে পারে, যারা শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে চায়।” তিনি আরও বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ও তথ্য প্রদানে কর্তৃপক্ষকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
শ্রীনগরের এই বিস্ফোরণ যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা সরকারের কাছে স্পষ্ট তথ্য ও নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই অঞ্চলের পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। ভারত ও পাকিস্তানের নেতৃত্ব কীভাবে এই ঘটনার জবাব দেয়, তা শান্তি প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, যা কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির ইঙ্গিত দেয়। তবে শ্রীনগরের ঘটনা প্রমাণ করে, কাশ্মীরের শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ এখনও দীর্ঘ ও জটিল।