যুদ্ধবিরতির পরও প্রস্তুত থাকার ঘোষণা ভারতীয় বাহিনীর

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কার্যকর হলেও ভারতীয় সামরিক বাহিনী স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তারা এখনো সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত রয়েছে। শান্তি ফেরালেও সম্ভাব্য যেকোনো হুমকির মুখে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তিন বাহিনী—থল, নৌ ও বিমান—সম্পূর্ণ সতর্ক অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছে ভারত।
শনিবার দিল্লিতে আয়োজিত এক বিশেষ সামরিক ব্রিফিংয়ে এই বার্তা দেন ভারতের তিন বাহিনীর প্রতিনিধিরা। এই ব্রিফিংয়ে প্রথমবারের মতো ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা অংশ নেন। কমোডর রঘু নায়ার বলেন, “যুদ্ধবিরতি ঘোষণার সিদ্ধান্ত সব বাহিনী মেনে চলবে। তবে বাহিনীসমূহ সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত এবং সজাগ রয়েছে। যদি ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়, তার যথাযথ জবাব দিতেও প্রস্তুত রয়েছি আমরা।”
তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্নে আমরা কখনোই ছাড় দিই না। প্রয়োজন হলে আবারও সামরিক পদক্ষেপ নিতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যেসব আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা শক্তভাবে প্রতিরোধ করা হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখন আগের চেয়ে আরও সুসংগঠিত ও জবাবদিহিতার মধ্যে রয়েছে।”
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভুয়া তথ্য প্রচারের অভিযোগ
ভারতীয় সামরিক বাহিনী আরও দাবি করেছে, সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ‘ভুয়া ও ভিত্তিহীন’ তথ্য ছড়ানো হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, পাকিস্তান নিজের জনগণকে বিভ্রান্ত করতে ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ভিন্ন বাস্তবতা তুলে ধরেছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি বলেন, “পাকিস্তানের তরফ থেকে যেসব তথ্য ছড়ানো হয়েছে তা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা বলেছে, আমাদের বিমান ও স্থল ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের কোনো কৌশলগত ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ ধরনের ভুয়া প্রচারমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পাকিস্তান শুধু নিজের মর্যাদাই ক্ষুণ্ণ করছে।”
কর্নেল কুরেশি জানান, যুদ্ধবিরতির ঠিক আগের দিনগুলোতে ভারতীয় বাহিনী সফলভাবে বেশ কয়েকটি অভিযান চালায় এবং পাকিস্তান অধিকৃত অঞ্চলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। তার ভাষায়, “এই অভিযানে পাকিস্তানের বেশ কিছু সেনা ও বিমানবাহিনীর স্থাপনাও লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।”
ধর্মীয় স্থানের বিষয়ে ভারতীয় সেনার ব্যাখ্যা
সম্প্রতি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, ভারতীয় বাহিনী তাদের একাধিক মসজিদে হামলা চালিয়েছে। এমন অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ভ্যোমিকা সিং বলেন, “ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আমরা প্রতিটি ধর্মীয় উপাসনালয়কে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে থাকি। আমাদের কোনো অভিযানেই ধর্মীয় স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি।”
তিনি বলেন, “আমাদের অভিযানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি এবং ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত কিছু কৌশলগত স্থাপনা। পাকিস্তান উদ্দেশ্যমূলকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি পেতে ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগাতে চেয়েছে।”
উইং কমান্ডার সিং আরও বলেন, “পাকিস্তান বারবার সংবাদ সম্মেলন করে তাদের পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির কথা এড়িয়ে গিয়েছে। এর পরিবর্তে তারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
যুদ্ধবিরতি ও কূটনৈতিক বাস্তবতা
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দুই দেশের মধ্যে একটি সাময়িক শান্তি নিশ্চিত করলেও পরিস্থিতি এখনো খুবই উত্তেজনাপূর্ণ রয়েছে। সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন ও বিমান টহল বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতীয় বাহিনী যেমন বলছে, তারা প্রস্তুত ও সজাগ, তেমনি পাকিস্তানও নতুন করে প্রতিরক্ষা মোতায়েন করছে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রাঘবেন্দ্র নাথ মনে করেন, “এই যুদ্ধবিরতি মূলত কূটনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ফল। তবে উভয় দেশই নিজেদের অবস্থান থেকে পিছু হটেনি। যার অর্থ, ছোট কোনো উসকানি থেকেই আবার সংঘর্ষ শুরু হতে পারে।”
জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া
এই সংঘর্ষ ও যুদ্ধবিরতির পটভূমিতে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেই জনগণের মধ্যে আশঙ্কা এবং উত্তেজনা বিরাজ করছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে সাধারণ মানুষ এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
কাশ্মীরের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, “গত কয়েকদিন গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের আওয়াজে আমরা রাতে ঘুমাতে পারিনি। এখন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি, তবে জানি না কতদিন এই শান্তি থাকবে।”
সমাপ্তি ও পরিপ্রেক্ষিত
যুদ্ধবিরতি যে শুধু একটি সাময়িক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তা ভারতীয় বাহিনীর বক্তব্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ভবিষ্যতে যদি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোনো উসকানি আসে, তবে জবাব আরও কঠোর হবে।
এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভারতের পক্ষ থেকে যে বার্তা এসেছে, তা একদিকে শান্তি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তায় কোনো ধরনের ছাড় না দেওয়ার অঙ্গীকার।
এই দ্বৈত বার্তা দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বাস্তবতায় এক গুরুত্বপূর্ণ পর্বের সূচনা করল। কূটনৈতিকভাবে এই সময়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল, যা শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, গোটা অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।