আঞ্চলিক

বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এই আন্দোলন, যা প্রাথমিকভাবে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে শুরু হয়েছিল, পরবর্তীতে সরকারের দমন-পীড়নের প্রতিবাদে একটি পূর্ণাঙ্গ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এই আন্দোলনের ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান, এবং দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তবে, আন্দোলনের সময় সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা, নির্যাতন, গুম, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ ওঠে, যা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদনেও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে, শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে আওয়ামী লীগ ও এর নেতাদের বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত, দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা, এবং ট্রাইবুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।” তিনি আরও জানান, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীও অনুমোদিত হয়। এই সংশোধনী অনুযায়ী, ট্রাইবুনাল এখন থেকে কেবল ব্যক্তি নয়, বরং রাজনৈতিক দল, তাদের অঙ্গসংগঠন, এবং সমর্থক গোষ্ঠীকেও শাস্তির আওতায় আনতে পারবে। এই সংশোধনী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করবে বলে আশা করা হচ্ছে। আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র আগামী কর্মদিবসে জারি করা হবে।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের উপর অভিযোগ

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, যা ‘জুলাই বিপ্লব’ নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই আন্দোলনের শুরু হয় সরকারি চাকরিতে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এই প্রতিবাদ ক্রমশ সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আন্দোলনের সময় পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, এবং ছাত্রলীগের সদস্যদের দ্বারা ব্যাপক সহিংসতা ও গণহত্যার অভিযোগ ওঠে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে প্রায় ১,৪০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ১১৮ জন শিশু। এছাড়া, প্রায় ৩১,০০০ মানুষ আহত এবং হাজার হাজার মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

এই অভিযোগগুলোর প্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, এবং জনগণের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। বিশেষ করে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই দাবির পক্ষে সোচ্চার ছিল। গত বুধবার মধ্যরাতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের থাইল্যান্ডে যাওয়ার ঘটনা এই দাবিকে আরও জোরালো করে। এনসিপি এবং অন্যান্য সংগঠন এই ঘটনার প্রতিবাদে শাহবাগসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ও বিচার প্রক্রিয়া

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধের শামিল, এবং এর জন্য শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতে পালিয়ে থাকা নেতাদের ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সহায়তা নেয়ার প্রয়োজন।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিচারের রায় ঘোষণা হতে পারে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন এই বিচার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তিনি আরও বলেন, এই প্রতিবেদন আওয়ামী লীগের গণহত্যাকারী দল হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করবে।

জুলাই ঘোষণাপত্র ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে, যা জুলাই বিপ্লবের আদর্শ ও লক্ষ্যকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত করবে। এই ঘোষণাপত্রে আন্দোলনের শহীদ ও আহতদের ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে।

প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জুলাই ঐক্যের মতো সংগঠন এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে, আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্তকে ‘অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ বলে সমালোচনা করেছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে যারা মাঠে আছেন, তারা একা নন; দেশের ১৮ কোটি মানুষ এই দলকে আর দেখতে চায় না।” তবে, তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের সিদ্ধান্তের উপর জোর দিয়েছেন।

উপসংহার

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই সিদ্ধান্ত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের শহীদ ও আহতদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে, এই সিদ্ধান্তের আইনি ও রাজনৈতিক প্রভাব কী হবে, তা ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচার প্রক্রিয়া এবং জুলাই ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন দেশের নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button