বিশ্ব

ভারতের অভিযোগ— ধর্মীয় স্থানে হামলার ছক কষছে পাকিস্তান

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে দিল্লির সাউথ ব্লক থেকে এক গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি শুক্রবার (৯ মে) দাবি করেছেন, পাকিস্তান ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে হামলার ছক কষছে। এই অভিযোগের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শুক্রবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে মিশ্রি এই অভিযোগ তুলে ধরেন। তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং। এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় স্থানগুলোকে লক্ষ্য করে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ তুলেছে, যা তিনি “মন্দির, গুরুদ্বারা এবং চার্চ” পর্যন্ত বিস্তৃত বলে উল্লেখ করেন।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগ

বিক্রম মিশ্রি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পাকিস্তান ভারতের ধর্মীয় স্থানগুলোকে বেছে বেছে হামলার নিশানা করার চেষ্টা করছে। তারা মন্দির, গুরুদ্বারা এবং চার্চের মতো স্থানগুলোকে টার্গেট করছে, যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর একটি ষড়যন্ত্র।” তিনি আরও দাবি করেন, “ভারত এই সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে এবং পাকিস্তানকে দায়িত্বশীল দেশের মতো যোগ্য জবাব দিচ্ছে।”

মিশ্রি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগও তুলেছেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তান দাবি করছে যে তারা কোনো ধর্মীয় স্থানে হামলা করেনি, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। গতকাল আমি জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্চ এলাকায় একটি গুরুদ্বারায় হামলার কথা উল্লেখ করেছিলাম। এই হামলার দায় স্বীকার করার পরিবর্তে পাকিস্তান মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে। তারা বলছে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং বিমান বাহিনী নাকি অমৃতসরে হামলা চালিয়েছে। এটি পাকিস্তানের আগ্রাসনের দায় এড়ানোর একটি কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।”

আকাশসীমা লঙ্ঘন ও ড্রোন হামলার অভিযোগ

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব আরও দাবি করেছেন, পাকিস্তান ভারতের আকাশসীমা একাধিকবার লঙ্ঘন করেছে। তিনি বলেন, “পাকিস্তান ভারতের ৩৬টি স্থানে আকাশসীমা লঙ্ঘনের চেষ্টা করেছে। তারা ৩০০ থেকে ৪০০টি ড্রোন ব্যবহার করে হামলার চেষ্টা চালিয়েছে। তবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এই চক্রান্ত ব্যর্থ করেছে এবং বেশিরভাগ ড্রোন ধ্বংস করেছে।”

মিশ্রি অভিযোগ করেন, পাকিস্তান ভারতের এয়ারস্ট্রাইক এড়াতে যাত্রীবাহী বিমানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, “এটি পাকিস্তানের কাপুরুষোচিত কৌশল, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। তারা বেসামরিক বিমানের নিরাপত্তার প্রতি কোনো সম্মান দেখাচ্ছে না।”

পুঞ্চে হামলা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার অভিযোগ

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি পুঞ্চে সাম্প্রতিক হামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “পুঞ্চে শিখ সম্প্রদায়ের একটি গুরুদ্বারা এবং একটি স্কুলে হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলায় দুজন স্কুলছাত্র নিহত হয়েছে। পাকিস্তান এই হামলার দায় ভারতের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে, যা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।”

বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং বলেন, “পাকিস্তান তুরস্কের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন স্থানে হামলার চেষ্টা করেছে। আমাদের বিমান বাহিনী এই হামলাগুলো প্রতিহত করেছে এবং বেশিরভাগ ড্রোন ধ্বংস করেছে। আমরা পাকিস্তানের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছি।”

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তান ভারতের এই অভিযোগগুলোকে “মিথ্যা ও ভিত্তিহীন” বলে উড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দপ্তরের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী এক বিবৃতিতে বলেন, “ভারত তার অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা ঢাকতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলছে। আমরা কোনো ধর্মীয় স্থানে হামলা করিনি। ভারতের এই অভিযোগগুলো বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার জন্য।”

তবে, ভারতের দাবি, পাকিস্তান তাদের সাম্প্রতিক হামলার দায় এড়াতে এই ধরনের বিবৃতি দিচ্ছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা পাকিস্তানের এই কৌশলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রমাণ উপস্থাপন করবে।

পটভূমি: পহেলগাঁও হামলা ও অপারেশন সিঁদুর

এই অভিযোগের পটভূমিতে রয়েছে গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে একটি সন্ত্রাসী হামলা। এই হামলায় ২৮ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন, যাদের অধিকাংশই হিন্দু পর্যটক ছিলেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তইয়েবার সঙ্গে যুক্ত ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’-কে দায়ী করেছে। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারত ৬ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি সামরিক অভিযান চালায়, যার মাধ্যমে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়।

ভারত দাবি করেছে, এই হামলাগুলো সন্ত্রাসী ঘাঁটি লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছিল। তবে পাকিস্তান অভিযোগ করেছে, ভারতের হামলায় বেসামরিক এলাকা, বিশেষ করে মসজিদ, লক্ষ্য করা হয়েছে, যার ফলে ২৬ জন নিহত এবং ৪৬ জন আহত হয়েছেন। এই ঘটনার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও অভিযোগ চলছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই উত্তেজনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস দুই দেশকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়া এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং উভয় দেশকে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে বলেছে।

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাস

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিরোধ চলছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ এবং সংঘর্ষ হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হামলার জন্য ভারত বারবার পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পরও ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল, যা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছিল।

উপসংহার

ভারতের সাম্প্রতিক অভিযোগ এবং পাকিস্তানের পাল্টা অভিযোগ দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে আরও তীব্র করেছে। ধর্মীয় স্থানগুলোকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করার অভিযোগ এই সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভারত দাবি করছে, তারা পাকিস্তানের চক্রান্ত ব্যর্থ করেছে এবং ভবিষ্যতেও কঠোর জবাব দেবে। অন্যদিকে, পাকিস্তান এই অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা নিরসনের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button