অর্থনীতি

মূলধন বাড়াতে বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারী খুঁজছে ইউসিবি

Advertisement

বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের অন্যতম পুরনো ও সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আগামী ২৮ জুন ২০২৫ তারিখে তার ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে। স্বাধীনতার মাত্র ১২ বছর পর ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করা এই ব্যাংক দেশের অর্থনীতির অভূতপূর্ব অগ্রগতির অন্যতম চালিকা শক্তি। ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিবর্তন, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ইউসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ প্রথম আলোর সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত জানান।

ইউসিবির প্রতিষ্ঠা ও অবদান

১৯৮৩ সালের ২৮ জুন, ইউসিবি দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি এবং বেসরকারি খাতের বিকাশই ছিল এই ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য। স্বাধীনতার পরকার সময় অর্থনীতির বেশির ভাগ অংশ পাকিস্তানি পরিবারের হাতেই থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য সীমাবদ্ধ ছিল। ইউসিবিসহ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক চালু হওয়ার পর দেশীয় উদ্যোক্তারা নতুন করে অর্থায়ন পেতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে বেসরকারি শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে।

“আমাদের মোট ঋণের ৭০ শতাংশই বেসরকারি করপোরেট খাতের গ্রাহকদের হাতে রয়েছে, যারা দেশের অর্থনীতিতে বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন,” জানান এমডি মামদুদুর রশীদ। বর্তমানে দেশের শীর্ষ করপোরেট গ্রুপের অনেকেই ইউসিবির নিয়মিত গ্রাহক।

ঋণ ও আমানতের অঙ্কে ইউসিবির অবস্থা

৪২ বছর ধরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে ইউসিবির আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১,৮০৩ কোটি টাকা এবং ঋণের পরিমাণ ৬০,৮৯৪ কোটি টাকা। মোট ফান্ড ব্যবস্থাপনার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। দেশের শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের তালিকায় ইউসিবির অবস্থান দৃঢ়। পোশাক খাতসহ বিভিন্ন শিল্প-খাতে ব্যাংকটির অর্থায়ন শীর্ষ স্থান দখল করেছে।

দেশজুড়ে ব্যাংকের রয়েছে ২৩১টি শাখা, ১৮১টি উপশাখা এবং ৬৪৫টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট, যেখানে মোট ২৪ লাখ ৬২ হাজার আমানতকারী রয়েছে। ব্যাংকের নিয়মিত কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৫,৭৮৯ জন।

চ্যালেঞ্জ ও পরিবর্তনের সময়

গত কয়েক বছরে বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনীতিতে ওঠানামা এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকিং খাতে চাপ বেড়েছে। ২০১০ সালের পর সুদের হার ঊর্ধ্বমুখী হলেও, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ বেড়েছে। ইউসিবির খেলাপি ঋণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশে, তবে এটি দেশের গড়ের থেকে ভালো অবস্থান।

ব্যাংকটির এমডি মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ জানান, “ব্যবসায়ীরা এখনো ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ নানা উদ্যোগে আমরা সহযোগিতা পেয়েছি। বর্তমানে নতুন করে আর্থিক সহায়তার পরিকল্পনাও চলছে।”

নতুন নেতৃত্ব ও পরিচালনায় পরিবর্তন

গত ২৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে ইউসিবির নানা দিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছে। এমডি হিসেবে যোগদানের পর থেকেই আমানত বৃদ্ধি এবং গ্রাহকের আস্থা ফিরে আনার দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। “আমরা চলতি বছরে ৬,২১৮ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছি, যা গত বছরের মোট আমানতের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের লক্ষ্য এই বছর ১২ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করা,” তিনি জানান।

ব্যাংকটি ইতোমধ্যে চারটি বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে ক্রেডিট লাইন চালু করেছে এবং বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারী খুঁজে মূলধন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনায় রয়েছে।

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দিকে এক নতুন অধ্যায়

আগামী পাঁচ বছরে ইউসিবি ব্যাংক তার ভোক্তা ও এসএমই ব্যাংকিং সেবাকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল করার ঘোষণা দিয়েছে। ব্যাংকের চারটি লাইসেন্স থাকায় সব ধরনের সেবা একযোগে দেওয়া সম্ভব হবে। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন রোবোটিক প্রসেস অটোমেশন (আরপিএ), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যাংকিংয়ে প্রবেশ করানো হচ্ছে যাতে গ্রাহকরা ঘরে বসে যেকোনো সময়ে সহজে ব্যাংকিং সেবা নিতে পারেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও লক্ষ্য

ইউসিবি ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরে ব্যাংককে আরও শক্তিশালী ও টেকসই প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। সুসাসনের সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে করপোরেট খাতের ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি মূলধন বৃদ্ধি, নতুন গ্রাহক সংগ্রহ ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button