বিশ্ব

শান্তি ও সুসম্পর্কে জোর, বিরোধ চায় না ভারত

Advertisement

বাংলাদেশের সঙ্গে বিবাদ চায় না ভারত: রাজনাথ সিং

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, নয়াদিল্লি কখনো বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো ধরনের বিরোধ বা উত্তেজনা চায় না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভারত সর্বদা তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ও শান্তি রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ।

সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নেটওয়ার্ক-১৮–কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে রাজনাথ সিং এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “ভারত কখনোই সংঘাত বা বিবাদের পথে হাঁটতে চায় না। আমরা শান্তি, সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে এগিয়ে যেতে চাই।”

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: নতুন এক বাস্তবতা

২০২৪ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। গণআন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ঘটনাটির পরপরই শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে জটিল করে তোলে। বিশেষ করে সীমান্তে নজরদারি, বাণিজ্যনীতি ও আঞ্চলিক কূটনীতিতে উভয় দেশই সতর্ক অবস্থান নেয়।

এই প্রেক্ষাপটে রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক রাখতে চাই। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শান্তি ও সহযোগিতার পথেই আমরা এগিয়ে যেতে চাই।”

রাজনাথ সিংয়ের বার্তা: শান্তিই ভারতের লক্ষ্য

রাজনাথ সিং সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত কখনোই অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। তিনি বলেন, “ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আমরা অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপে বিশ্বাস করি না। আমাদের লক্ষ্য আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা।”

তিনি আরও বলেন, “যদি কোথাও উত্তেজনা তৈরি হয়, আমরা কূটনৈতিক পথে তা সমাধানের চেষ্টা করি। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ভারতের অগ্রাধিকার।”

তার এই বক্তব্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের দিকনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সতর্ক বার্তা

এক প্রশ্নের জবাবে রাজনাথ সিং বলেন, “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেন ভেবেচিন্তে কথা বলেন। দুই দেশের সম্পর্ক এমন কিছু দিয়ে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করা উচিত।”

তার এই মন্তব্যকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এক ধরনের ‘কূটনৈতিক বার্তা’ হিসেবেই দেখছেন।
ভারতের সরকার চায়, বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্ব যেন এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নেয় যা আঞ্চলিক সহযোগিতা বা নিরাপত্তা চুক্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

উল্লেখ্য, গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশ কিছু অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সীমান্তে অনুপ্রবেশ, পাচার, এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা স্থগিত আছে।

ভারতের উদ্বেগ ও কূটনৈতিক কৌশল

ভারত সবসময় বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে এসেছে। বাণিজ্য, জ্বালানি সহযোগিতা, নৌপথ ব্যবহার, ও সীমান্ত নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ভূমিকা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনাথ সিং বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে পরস্পরের লাভজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। আমরা বিশ্বাস করি, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমেই আঞ্চলিক উন্নয়ন সম্ভব।”

তিনি আরও বলেন, ভারত সব সময় বাংলাদেশের উন্নয়নকে সহায়তা করেছে—চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার থেকে শুরু করে রেল ও বিদ্যুৎ সংযোগ পর্যন্ত।

তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নয়াদিল্লি কিছুটা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে সম্মান করে, তবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তারা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে।

শেখ হাসিনার নির্বাসন ও দ্বিপাক্ষিক প্রভাব

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পতন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন। তার নির্বাসন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে।

ভারতের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তার সরকারের সময় সীমান্ত সহযোগিতা, সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ এবং আঞ্চলিক সংযোগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল।

অন্যদিকে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার নতুন ধরণের নীতি প্রয়োগ করছে, যা ভারতের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়।
এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি একদিকে যেমন সতর্ক, তেমনি অন্যদিকে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টাও করছে।

পাক-আফগান উত্তেজনা ও ভারতের অবস্থান

সাক্ষাৎকারে রাজনাথ সিং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত উত্তেজনা নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, “ভারত কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। তবে আমরা সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে আছি।”

তিনি উল্লেখ করেন, ভারত শান্তির পক্ষে, কিন্তু দেশের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আপস করবে না। “আমরা যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী,” বলেন রাজনাথ।

এই বক্তব্যও আঞ্চলিক নিরাপত্তার বার্তা দেয়, যা বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক।

দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির আহ্বান

রাজনাথ সিং বলেন, “দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। এখানে যদি শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তবে সবাই উপকৃত হবে। ভারত সে লক্ষ্যেই কাজ করছে।”

তিনি বলেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে ভারত একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন, আঞ্চলিক বিদ্যুৎ সংযোগ, নদীর পানি ব্যবস্থাপনা, এবং বাণিজ্য রুটের সম্প্রসারণ।

ভারত চায়, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাক।

বাংলাদেশে ভারতের কূটনৈতিক প্রতিনিধি অফিসের ভূমিকা

নয়াদিল্লির নির্দেশে ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের দায়িত্বে কাজ করছে।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা পুনরায় সক্রিয় করার উদ্যোগ চলছে।
ভারতের ব্যবসায়ী মহলও বাংলাদেশের বাজারে পুনরায় আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।

শান্তি, সহযোগিতা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্ক

রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য শুধু একটি রাজনৈতিক মন্তব্য নয়, বরং ভারতের কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে শান্তি ও সহযোগিতার সম্পর্ক চায়।

বিশ্লেষকদের মতে, এখন দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক অনেকটাই নির্ভর করছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কূটনৈতিক দিকনির্দেশনা এবং ভারতের প্রতিক্রিয়ার ওপর।
যদি উভয় দেশ পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল থাকে, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন শান্তি ও উন্নয়নের অধ্যায় শুরু হতে পারে।

MAH – 13662 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button