বিশ্ব

সুদানের আল-ফাশেরে গণহত্যা থামছেই না, প্রমাণ মিলল স্যাটেলাইট চিত্রে

Advertisement

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব জানিয়েছে, সুদানের আল-ফাশের শহরে গণহত্যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি তোলা স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে শহরের বিভিন্ন এলাকা ও সামরিক স্থাপনায় মানবদেহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বস্তু এবং লালচে দাগ দেখা গেছে, যা রক্তের প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সুদানের গৃহযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) ও সুদানের সেনাবাহিনীর (এসএএফ) মধ্যে সংঘাত। ২৭ অক্টোবর এল-ফাশার শহর আরএসএফ-এর দখলে চলে যায় এবং তারপর থেকে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে।

আল-ফাশারের দখল ও আরএসএফ-এর কার্যক্রম

আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফ এল-ফাশার শহর দখল করার পর সেনাবাহিনীকে তাদের শেষ ঘাঁটি থেকে তাড়িয়ে দেয়। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা যেমন ষষ্ঠ ডিভিশনের সদরদপ্তর এবং ১৫৭তম আর্টিলারি ব্রিগেড দখল করা হয়।

এই দখলের পর মৃত্যুদণ্ড, যৌন সহিংসতা, অপহরণ ও লুটপাট চালানো হয়েছে। ত্রাণকর্মীদের ওপরও হামলার খবর পাওয়া গেছে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। স্থানীয়দের বর্ণনা অনুযায়ী, মানুষদের পরিবারে সামনেই হত্যা করা হচ্ছে এবং পালিয়ে যাওয়ার সময় বেসামরিক নাগরিকদের মারধর করা হচ্ছে।

স্যাটেলাইট চিত্রে ভয়াবহতার প্রমাণ

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ও এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস-এর স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, শহরের মাঠ, রাস্তাঘাট এবং সামরিক স্থাপনায় লালচে দাগ এবং মৃতদেহের স্তূপ স্পষ্ট। বিশ্লেষকরা বলছেন, মহাকাশ থেকে এই দৃশ্যগুলো দেখা যায় এবং এ থেকে বোঝা যায় গণহত্যা থামেনি।

গবেষকরা অন্তত ৩১টি স্থানে মানুষের দেহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বস্তু শনাক্ত করেছেন। এ ছাড়া স্থানীয়দের বিবৃতিতে দেখা যায়, আরএসএফ সদস্যরা বেছে বেছে নাগরিকদের হত্যা করছে। নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন এবং পুরুষদের পরিবার থেকে আলাদা করে হত্যা করা হচ্ছে।

মানবিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব

জাতিসংঘের কর্মকর্তারা সতর্ক করে জানিয়েছেন, এল-ফাশারের গণহত্যা এবং কোর্দোফান অঞ্চলে সংঘটিত নৃশংসতা বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকট
জাতিসংঘের মানবিক প্রধান টম ফ্লেচার বলেছেন, এল-ফাশার এখন বিপর্যস্ত মানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি এবং এটি নারীদের, শিশুদের ও বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

সুদানের চলমান গৃহযুদ্ধ ইতোমধ্যেই দশ-দশ হাজার মানুষ নিহত এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সহায়তা কার্যক্রমও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

স্থানীয়দের বর্ণনা

নিরাপদে পালিয়ে আসা মানুষদের কথায়, শহরে যারা টিকে আছে তারা আতঙ্কিত। ইউসুফ নামের একজন বাসিন্দা বলেছেন, “পুরুষ, নারী সবাইকে হত্যা করা হচ্ছে।”
মিনাল নামে আরেক ব্যক্তি জানিয়েছেন, পালানোর সময় আরএসএফ সদস্যরা সন্দেহভাজনদের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের অন্যান্য সদস্যকেও হত্যা করেছে।
ইকরাম নামে একজন নারী বলেন, “যোদ্ধারা আমাদের সামনে নির্যাতন চালিয়েছে। আমরা শুধু পিছন থেকে গুলির শব্দ শুনেছি।”

এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, গণহত্যা কেবল এল-ফাশারেই সীমাবদ্ধ নয়, পার্শ্ববর্তী এলাকা ও প্রদেশগুলিতেও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

সুদানের গৃহযুদ্ধ ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হয়। সুদানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং আরএসএফ কমান্ডার মোহাম্মদ হামদান দাগালোর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হয়।

এরপর পশ্চিম দারফুরের এল-ফাশার শহরটি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, ২৭ অক্টোবর আরএসএফ পুরো শহরের দখল নেয়। এরপর শহরে ব্যাপক গণহত্যা ও নৃশংসতা চালানো হয়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আরএসএফ-এর কার্যক্রম নিন্দা করেছে। আফ্রিকা বিষয়ক সহকারী মহাসচিব মার্থা পোবি জানিয়েছেন, কোর্দোফান ও এল-ফাশারের পরিসরে নাগরিকদের উপর ব্যাপক নৃশংসতা চলছে। এ সময় অন্তত ৫০ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচজন রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবক।

জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, শহরে ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নৃশংসতার মাত্রা এমন যে, মানবিক সহায়তা কার্যক্রমও কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।

স্যাটেলাইট চিত্র ও স্থানীয়দের বিবরণ থেকে নিশ্চিত যে, সুদানের আল-ফাশারে গণহত্যা থামেনি। আরএসএফ-এর দখলের পর থেকে বেসামরিক নাগরিকদের উপর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও লুটপাট চলছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও, মানবিক সংকটের মাত্রা ক্রমশ ভয়াবহ হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সঠিক আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ এবং মানবিক সাহায্য ছাড়া পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। এল-ফাশারের এই গণহত্যা দারফুরে ২০ বছর আগের জাতিগত নিধনের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা তৈরি করেছে।

এম আর এম – ২০৩৬,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button