বিশ্ব

পর্তুগালের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত: ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলো লিসবন

Advertisement

মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ দশকের সংগ্রামের পর ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে এবার নতুন মাত্রা যোগ করলো পর্তুগাল। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার পর ইউরোপের এই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় দেশটিও ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

জাতিসংঘ অধিবেশনের প্রাক্কালে ঘোষণা

গত রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের প্রাক্কালে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন পর্তুগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো রাঞ্জেল।

তিনি বলেন, “পর্তুগাল এখন থেকে ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এটি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি মৌলিক, ধারাবাহিক এবং অপরিহার্য অংশ।”

এই ঘোষণার মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর তালিকায় আরও একটি প্রভাবশালী নাম যুক্ত হলো।

পূর্ববর্তী স্বীকৃতিগুলো

এর আগে ২০২৫ সালের শুরুর দিকে ব্রিটেন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেয়। একে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এক নতুন মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে কেন্দ্র করে বিশ্ব সম্প্রদায় বিভক্ত থাকলেও পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় শক্তিধর দেশগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করায় সমীকরণ বদলে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

পর্তুগালের ঘোষণার পর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এক বিবৃতিতে বলেন, “এই স্বীকৃতি শুধু রাজনৈতিক সমর্থন নয়, এটি আমাদের স্বাধীনতার ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি বিশ্বজনমতের স্বীকৃতি।”

অন্যদিকে ইসরায়েল এই সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এমন পদক্ষেপ শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। ইসরায়েল বহুবার দাবি করেছে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান খুঁজে বের করা উচিত।

কেন গুরুত্বপূর্ণ এই স্বীকৃতি?

বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু প্রতীকী নয়, এটি ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক বাস্তবতারও ইঙ্গিত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো একে একে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে ইসরায়েলের চাপ বাড়বে।

জাতিসংঘে ইতোমধ্যে ১৩০টির বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে এতদিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া বিষয়টিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। তাদের অবস্থান বদলে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারসাম্যের পরিবর্তন হতে পারে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরে পরিবর্তন

পর্তুগালের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তত ৯টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে—ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের মতো বড় শক্তিগুলো কি একই পথে হাঁটবে?

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ইউরোপ নিজেদের কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে। এ কারণে ফিলিস্তিন প্রশ্নে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যাচ্ছে।

পর্তুগালের ভূমিকা ও কূটনৈতিক অবস্থান

পর্তুগাল ঐতিহাসিকভাবে মানবাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে আসছে। আফ্রিকার দেশগুলোর মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দেশটির সমর্থন ছিল দৃশ্যমান। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে লিসবন সেই ধারাবাহিকতারই প্রকাশ ঘটালো।

পর্তুগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো রাঞ্জেল আরও বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের একমাত্র পথ। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে আমরা সেই শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকেই এগোচ্ছি।”

ফিলিস্তিনের সংগ্রাম: সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের ভূমি, অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে আসছে।

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা উপত্যকা ইসরায়েলের দখলে চলে যায়। এই অঞ্চলগুলোই ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত। কিন্তু ইসরায়েলের ক্রমাগত বসতি স্থাপন কার্যক্রম ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ সেই প্রক্রিয়াকে জটিল করেছে।

১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগঠন (পিএলও) স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে এবং তখন থেকেই জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে স্বীকৃতির জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব

পর্তুগালের স্বীকৃতি কেবল মধ্যপ্রাচ্যে নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এখনও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি, তবে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা একে একে স্বীকৃতি দেওয়ায় ওয়াশিংটনের ওপর চাপ বাড়বে।

একইভাবে আরব লীগ ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) দেশগুলোর মধ্যে স্বস্তির সঞ্চার হয়েছে। তারা মনে করছে, পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন বাড়লে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হবে।

মানবিক দিক

বিশ্বের অন্যতম বড় মানবিক সংকট ফিলিস্তিনে বিদ্যমান। গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে কোটি মানুষের জীবনযাত্রা দারিদ্র্য, অবরোধ ও সহিংসতার কারণে চরম দুর্দশাগ্রস্ত। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামকে আরও বৈধতা দেবে এবং মানবিক সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সামনে কী অপেক্ষা করছে?

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী মাসগুলোতে আরও কিছু ইউরোপীয় দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারে। বিশেষত স্পেন ও আয়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে ইতিবাচক অবস্থান নিয়ে আসছে।

তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে। বিশ্বের প্রধান শক্তি যদি এখনও নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়, তাহলে ইসরায়েলের ওপর চাপ সীমিত থাকবে। কিন্তু ইউরোপ ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো একে একে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।

পর্তুগালের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রামে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। পাশাপাশি এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও নতুন মাত্রা যোগ করলো।

একটি ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই সমাধান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়—এটি আবারও প্রমাণিত হলো। আর সেই সমাধানের পথেই বিশ্ব সম্প্রদায়কে অগ্রসর হতে হবে।

MAH – 12939 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button