ক্রিকেট

মুলতানের অনন্য উদ্যোগ, ছক্কায় ফিলিস্তিন সহায়তা

ক্রিকেট মাঠে চার-ছক্কার ধুন্ধুমার উত্তেজনা নতুন কিছু নয়। তবে সেই উত্তেজনা যদি মানবিকতার ছোঁয়া পায়, তাহলেই ক্রীড়ার প্রকৃত সৌন্দর্য ধরা পড়ে। পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) দশম আসরে এমন এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দল মুলতান সুলতানস। মাঠের প্রতিটি বাউন্ডারি, প্রতিটি উইকেট তারা উৎসর্গ করেছে যুদ্ধক্লান্ত গাজা উপত্যকার শিশুদের জন্য।

শুধু কথা নয়, মাঠেই সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তব প্রয়োগ দেখা গেছে। ইতোমধ্যে প্রথম ম্যাচেই প্রায় ১৫ লাখ পাকিস্তানি রুপি জমা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে গঠিত তহবিলে।

মাঠের প্রতিশ্রুতি: ছক্কা, চার, উইকেট—সবই ফিলিস্তিনের জন্য

শনিবার, ১২ এপ্রিল করাচির বিপক্ষে পিএসএলের এবারের আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামে মুলতান সুলতানস। টস করতে নেমেই দলের অধিনায়ক মোহাম্মদ রিজওয়ান ঘোষণা দেন, দলটি তাদের প্রতিটি ছক্কা, চার এবং উইকেটকে অর্থমূল্যে রূপান্তর করে ফিলিস্তিনে পাঠাবে মানবিক সহায়তা হিসেবে।

রিজওয়ান বলেন,

“আমাদের প্রতিটি ছক্কা, প্রতিটি চার এবং প্রতিটি উইকেটে গাজার শিশুদের জন্য কিছু করতে চাই। তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব।”

এই ঘোষণা দর্শকদের হৃদয়ে নাড়া দেয়। পুরো স্টেডিয়ামজুড়ে এমন এক মানবিক বার্তা ছড়িয়ে পড়ে, যা খেলাকে শুধুই প্রতিযোগিতা নয়, বরং সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

ম্যাচের পরিসংখ্যানেই মানবিক অনুদান

করাচির বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ২৩৪ রানে থামে মুলতানের ইনিংস। তারা হাঁকায় ৮টি ছক্কা ও ২৩টি চার। ম্যাচে মোট উইকেট নেয় তারা ৪টি। প্রতিটি ছক্কা, চার এবং উইকেটের জন্য নির্ধারিত ১ লাখ রুপি হারে গণনা করে দেখা যায়, শুধুমাত্র এই ম্যাচ থেকেই তহবিলে জমা হয়েছে ১৫ লাখ রুপি

ক্রিয়াসংখ্যাপ্রতি ইউনিট অনুদান (PKR)মোট অনুদান (PKR)
ছক্কা১,০০,০০০৮,০০,০০০
চার২৩১,০০,০০০২৩,০০,০০০
উইকেট১,০০,০০০৪,০০,০০০
মোট১৫,০০,০০০

মালিকের বার্তা: ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, সমাজের প্রতিফলন

মুলতান সুলতানস ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক আলী খান তারিন এক ভিডিও বার্তায় এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের পেছনের ভাবনার কথা জানান।

তিনি বলেন,

“আমরা পিএসএলের এবারের আসরকে শুধু খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। আমরা মানবতার পাশে থাকতে চাই। গাজায় হাজারো শিশু প্রতিদিন যুদ্ধ ও বোমার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। তাদের জন্য কিছু করা আমাদের কর্তব্য মনে হয়েছে।”

তিনি আরও জানান, এই তহবিল শুধুমাত্র ব্যাটারদের পারফরম্যান্স থেকেই নয়, বোলারদের উইকেট শিকারের মাধ্যমেও বাড়বে। প্রতিটি উইকেটেও থাকছে ১ লাখ রুপির অনুদান।

গাজার বাস্তবতা: মানবিক বিপর্যয়ের মুখে শিশু-কিশোররা

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ড কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার শিশু। ধ্বংস হয়ে গেছে হাসপাতাল, স্কুল, ঘরবাড়ি। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এমন নিদারুণ মানবিক বিপর্যয় বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে মুলতান সুলতানস-এর এই মানবিক পদক্ষেপ ক্রীড়াজগতের বাইরেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে।

শুধু তহবিল নয়, সচেতনতার বার্তাও

এই উদ্যোগের মাধ্যমে শুধু অর্থসাহায্যই নয়, ফিলিস্তিনে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়েও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে উঠেছে রিজওয়ানের বক্তব্য, আলী খান তারিনের ভিডিও বার্তা এবং ম্যাচে প্রতিটি বাউন্ডারির পর স্ক্রিনে ভেসে ওঠা “This One’s for Gaza” বার্তা।

ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেকেই এই উদ্যোগকে ক্রীড়াক্ষেত্রে ‘social responsibility’-এর একটি চমৎকার উদাহরণ হিসেবে দেখছেন।

আরও ম্যাচ, আরও অনুদান

মুলতান সুলতানস আগামী বুধবার, ১৬ এপ্রিল ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের মুখোমুখি হবে রাওয়ালপিন্ডিতে। সেখানে আরও চার-ছক্কার ফোয়ারা ও বোলারদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখা গেলে, তহবিল আরও সমৃদ্ধ হবে।

দর্শকরা যেমন মাঠের উত্তেজনা উপভোগ করছেন, তেমনই মানবিক সহানুভূতিতে যুক্ত হতে পেরে তারা গর্বিত। এই উদ্যোগে উৎসাহিত হয়ে ভবিষ্যতে আরও অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি এমন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন ক্রীড়া বিশ্লেষকরা।

খেলাধুলার গণ্ডি পেরিয়ে মানবিকতা

মুলতান সুলতানস-এর এই ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ প্রমাণ করেছে, খেলার আসর কেবল প্রতিযোগিতা নয়— বরং মানবিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার এক অনন্য মাধ্যম। পিএসএলের মঞ্চে প্রতিটি বাউন্ডারি, প্রতিটি উইকেট যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের মুখে হাসি ফোটাতে অবদান রাখে, তখনই ক্রীড়ার আসল জয় হয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button