জাতীয়

বঙ্গোপসাগরে ৫৮ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা শুরু: জেলেদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ

বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সমুদ্রের মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে ১৪ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ওপর ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। নতুন এই সময়সীমা অনুযায়ী, প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের জলসীমায় সামুদ্রিক মাছ শিকারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে।

এই সিদ্ধান্তে উপকূলের প্রায় পাঁচ লাখ জেলে পরিবারের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, অধিকাংশ জেলে দীর্ঘ মেয়াদে এর সুফল পাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এতদিন ধরে যে বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছিল বাংলাদেশের জেলেদের, এবার তার অবসান হলো।

নিষেধাজ্ঞার পেছনের কারণ কী?

বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের অবাধ প্রজনন ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করতেই এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রূপচাঁদা, ইলিশ, চিংড়ি, কোরাল, লইট্টা, এবং টুনা মাছের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি, যেগুলো দেশের মাছ রপ্তানি খাতের বড় অংশ জোগান দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়টিতেই সাগরে মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম শুরু হয়। মাছ ধরার ট্রলার চলাচল থাকলে ডিম ছাড়ার প্রক্রিয়ায় বাধা পড়ে। ফলে আগামীতেও উৎপাদন হুমকিতে পড়ে। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করলে ভবিষ্যতে মাছের পরিমাণ ও প্রজাতির বৈচিত্র্য অনেকাংশে বেড়ে যাবে।

পূর্বের সময়সীমা বনাম বর্তমান

পূর্বে বাংলাদেশে সামুদ্রিক মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা ছিল ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত। এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের জেলেরা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকত ১৫ এপ্রিল থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত। ফলে দেখা যেত, বাংলাদেশের জেলেরা যখন সমুদ্রে যেতে পারছেন না, তখন ভারতের জেলেরা বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে নির্বিঘ্নে মাছ ধরছেন।

এই অনিয়মের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন বাংলাদেশি জেলেরা, যাদের মাছ ধরার মৌসুমে বাধা আসত, আবার নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা মেলেনি ভারতের সঙ্গে। দীর্ঘদিন ধরে জেলেরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন নিষেধাজ্ঞার সময় ভারতের সঙ্গে সমন্বয়ের।

এবার সরকারের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ও ভারতের নিষেধাজ্ঞা প্রায় একই সময়ের মধ্যে পড়বে, ফলে বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সুরক্ষিত থাকবে এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ অনেকাংশে কমবে।

জেলেদের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেরা এই সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পটুয়াখালীর আলীপুর এলাকার জেলে জসিম উদ্দিন বলেন,

“আমরা অনেক দিন ধরেই সরকারের কাছে বলতাম— ভারত যখন মাছ ধরে, আমরা বসে থাকি। আর আমরা মাছ ধরতে গেলে ওরা চলে যায়। এখন অন্তত একটা ভারসাম্য আসবে।”

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর জেলে শাহ আলম বলেন,

“মাছের প্রজনন ঠিক থাকলে ভবিষ্যতে বেশি মাছ ধরা যাবে। এটা আমাদেরই উপকারে আসবে। তবে সরকার যদি নিষেধাজ্ঞার সময় চাল-আর্থিক সহায়তা ঠিকমতো দেয়, তাহলেই কষ্ট সইতে পারব।”

অর্থনৈতিক প্রভাব ও সরকারি সহায়তা

প্রতি বছর মাছ ধরার মৌসুমে জেলেরা সমুদ্রগামী ট্রলার নিয়ে মাছ ধরেন। নিষেধাজ্ঞার সময় তাদের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে দরিদ্র জেলে পরিবারগুলোর জীবিকা হয়ে পড়ে অনিশ্চিত।

সরকার প্রতি বছর নিষেধাজ্ঞার সময়ে প্রতিটি নিবন্ধিত জেলে পরিবারকে ৮৬ কেজি চাল এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। তবে অনেক সময় এই সহায়তা বিলম্বিত হয় কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে জটিলতার মুখে পড়ে।

চলতি বছর যেন জেলেরা ঠিকমতো সহায়তা পান, সে বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সজাগ রয়েছে বলে জানিয়েছে। এরই মধ্যে দেশের ১৪টি উপকূলীয় জেলায় প্রশাসন ও স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে সহায়তা দ্রুত পৌঁছায়।

ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার নতুন দৃষ্টান্ত

এই নিষেধাজ্ঞা কেবল বাংলাদেশ একা দিচ্ছে না। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় একই সময় ধরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দুটি দেশের সময়সীমা মিলিয়ে নেওয়ার ফলে সাগরের জীববৈচিত্র্য আরও ভালভাবে সংরক্ষিত থাকবে।

আন্তর্জাতিক জলসীমার কাছাকাছি থাকা এলাকায় নিরাপত্তা ও নজরদারি জোরদার করা হচ্ছে যাতে কোনো দেশের জেলেরা অবৈধভাবে অন্য দেশের জলসীমায় না ঢুকতে পারে। কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী এবং মৎস্য বিভাগের টহল কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

পরিবেশবিদদের মন্তব্য

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাগরের মৎস্য সম্পদ রক্ষা করা না গেলে আগামী এক দশকের মধ্যেই সমুদ্র থেকে মাছের সরবরাহ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি সৈয়দ নূরুল আলম বলেন,

“প্রাকৃতিক সম্পদ একবার ধ্বংস হলে পুনরুদ্ধার করা কঠিন। নিষেধাজ্ঞা এ কারণে খুবই জরুরি। তবে বাস্তবায়নটা নিরপেক্ষ ও কঠোরভাবে করতে হবে।”

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা

বাংলাদেশ সরকার আগামীতে আরও আধুনিক ফিশারিজ মনিটরিং সিস্টেম (Vessel Monitoring System – VMS) চালুর পরিকল্পনা করছে, যাতে ট্রলারগুলোর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পাশাপাশি, ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স ব্যবস্থা, ট্রলার সংখ্যা সীমিতকরণ এবং সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল (Marine Protected Area) বাড়ানোর চিন্তাও করা হচ্ছে।

বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা কেবল মৎস্য সংরক্ষণের জন্য নয়, এটি জেলেদের জীবন-জীবিকায় ভারসাম্য আনারও একটি পদক্ষেপ। দীর্ঘদিন পর জেলেদের দাবি পূরণ হওয়ায় যেমন তারা খুশি, তেমনি পরিবেশবিদরাও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।

তবে এর সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সরকারি তত্ত্বাবধান, প্রণোদনার সুষ্ঠু বণ্টন, এবং সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি। তাহলেই প্রকৃতি ও মানুষ—দুইয়েরই হবে কল্যাণ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button