ক্রিকেট

ঐতিহাসিক জয়: কিউইদের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম সাফল্য

Advertisement

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল অবশেষে। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ১২ বার চেষ্টা করার পর অবশেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেল কাঙ্ক্ষিত সেই জয়। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি — প্রতিটি ফরম্যাটেই নিউজিল্যান্ডে জয়ের জন্য তারা লড়েছে বহুবার, কিন্তু সাফল্য এলো না এতদিন। আর আজ অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৭ রানের রুদ্ধশ্বাস জয়ে সেই ইতিহাস গড়ে ফেলল ক্যারিবিয়ানরা।

এই জয়ের মাধ্যমে শুধু সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়াই নয়, বরং ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রমাণ করল — ঘরের বাইরে তারা আবারও লড়াইয়ের চেতনা ফিরে পেয়েছে।

সিরিজের প্রেক্ষাপট: দুই দলের বাস্তবতা

ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরপর দুটি টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারার পর নিউজিল্যান্ডের সামনে ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সেটি সহজ ছিল না। দলের অভিজ্ঞ অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন ইতিমধ্যেই টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছেন। এর ওপর ইনজুরিতে বাইরে রয়েছেন তিন গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার — ওপেনার ফিন অ্যালেন, উইকেটরক্ষক ব্যাটার টিম সাইফার্ট এবং গতিময় পেসার লকি ফার্গুসন

তবু ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডকে ফেভারিট ধরা হচ্ছিল। ডেভন কনওয়ে, রাচিন রবীন্দ্র, মিচেল স্যান্টনারদের নিয়ে কিউই শিবির ছিল আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু মাঠের লড়াই অন্য গল্প বলেছে।

ব্যাটিংয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ধীর শুরুর পর স্থিরতার ছোঁয়া

টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ শুরুটা বেশ সতর্কভাবে করে। অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে ছোট বাউন্ডারি ও ভালো উইকেট থাকলেও শুরুতে নিউজিল্যান্ডের বোলাররা চাপে রাখে ক্যারিবিয়ান ব্যাটারদের।

প্রথম ১০ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে ৬৬ রান তুলেছিল তারা। কিন্তু অধিনায়ক শাই হোপ ছিলেন একদম আলাদা ছন্দে। ঠান্ডা মাথায় ইনিংস সাজিয়ে ৩৯ বলে করেন ৫৩ রান। তাঁর ইনিংসটিতে ছিল ৬টি চার ও ২টি ছক্কার মার।

হোপের সঙ্গে জুটি গড়ে রোভম্যান পাওয়েল করেন ৩৩ রান এবং রোস্টন চেজ যোগ করেন ২৮ রান। শেষ দিকে জেসন হোল্ডাররোমারিও শেপার্ড কিছু ছোট কিন্তু কার্যকর ইনিংস খেলে দলকে নিয়ে যান ১৬৪ রানে।

নিউজিল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে সফল বোলার ছিলেন জ্যাক ফোকসজ্যাকব ডাফি, দুজনই পেয়েছেন ২টি করে উইকেট।

নিউজিল্যান্ডের রান তাড়া: ভালো শুরু, এরপর ধস

১৬৫ রানের লক্ষ্য টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে অকল্যান্ডের মতো উইকেটে খুব বড় নয়। তাই কিউইরা আশাবাদী ছিল শুরু থেকেই। ওপেনার ডেভন কনওয়েটিম রবিনসন মিলে ঝড়ো সূচনা করেন।

তবে ৩১ রানে কনওয়ে আউট হওয়ার পর শুরু হয় নিউজিল্যান্ডের ধস। নিয়মিত ব্যবধানে উইকেট হারিয়ে তারা ১২.৪ ওভারে ৮৮ রানে হারায় ৬ উইকেট। কেউই ব্যাটে স্থায়ী হতে পারেননি — রবীন্দ্র ২১, রবিনসন ২৭ রান করে ফিরে যান।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে দারুণ বোলিং করেন রোস্টন চেজজেইডেন সিলস। দুজনই তুলে নেন ৩টি করে উইকেট। তাদের সুনিপুণ স্পেলেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ক্যারিবিয়ানদের হাতে।

শেষের নাটক: স্যান্টনারের ঝড়, কিন্তু জয় অধরাই

ম্যাচের এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল নিউজিল্যান্ড হাল ছেড়ে দিয়েছে। ১৫.২ ওভারে স্কোরবোর্ডে ১০০ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে তারা ছিল একেবারেই ব্যাকফুটে।

কিন্তু অধিনায়ক মিচেল স্যান্টনার তখনও হার মানেননি। শেষ উইকেটে জ্যাকব ডাফিকে নিয়ে গড়েন এক অবিশ্বাস্য জুটি। দুজন মিলে মাত্র ২০ বলে তোলেন ৫০ রান — যা টি-টোয়েন্টিতে টেস্ট খেলুড়ে দলের শেষ উইকেটে সবচেয়ে বড় জুটি হিসেবে নতুন রেকর্ড।

১৮তম ওভারে ক্যারিবিয়ান পেসার ম্যাথিউ ফোর্ডকে ছক্কা ও তিন চারে মারেন স্যান্টনার, সেই ওভার থেকে আসে ২৩ রান। এরপর পরের ওভারেও মারেন তিনটি টানা চার। অকল্যান্ডের দর্শকরা তখন উল্লাসে মাতোয়ারা, মনে হচ্ছিল হয়তো কিউইরা অসম্ভব কিছু করে ফেলবে।

কিন্তু শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ২০ রান। সেই ওভারে মাত্র ১২ রান তুলতে পেরে ইনিংস শেষ হয় ৯ উইকেটে ১৫৭ রানে। ৭ রানে হেরে যায় নিউজিল্যান্ড।

স্যান্টনার অপরাজিত থাকেন ২৮ বলে ৫৫ রানে, যাতে ছিল ৮টি চার ও ২টি ছক্কা। শেষ পর্যন্ত তিনিই দলের একমাত্র লড়াকু ব্যাটার হিসেবে প্রশংসিত হন।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঐতিহাসিক জয়: ১২ ম্যাচ পর সাফল্যের মুখ

এই জয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এর আগে তারা কখনোই টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জিততে পারেনি।

এ ছিল তাদের ১২তম প্রচেষ্টা — আগের ১১ ম্যাচের মধ্যে দুটি ম্যাচ টাই হয়েছিল, যার একটিতে সুপার ওভারে জয় পেলেও সেটি “আধা জয়” হিসেবেই থেকে গিয়েছিল।

আজকের জয়ে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটল। এই ম্যাচে দলের দুই প্রধান বোলার চেজসিলস ছিলেন সাফল্যের মূল স্থপতি, সঙ্গে ছিলেন অধিনায়ক হোপের শান্ত ইনিংস। ম্যাচ শেষে হোপ বলেন —

“এটা শুধুই একটা জয় নয়, এটা আমাদের দলের বিশ্বাস ফেরানোর ম্যাচ। আমরা অনেক সময় জয়ের কাছাকাছি গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি, কিন্তু আজ সবাই নিজেদের সেরাটা দিয়েছে।”

ম্যাচসেরা: রোস্টন চেজ

দারুণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের জন্য ম্যাচসেরা হয়েছেন রোস্টন চেজ। ৩ ওভারে মাত্র ২৬ রান দিয়ে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে করেছেন ২৮ রান। তিনি বলেন —

“নিউজিল্যান্ডে খেলা সবসময় কঠিন। এখানে উইকেট অনেক দ্রুত এবং বাতাসের প্রভাবও বেশি। কিন্তু আমরা দল হিসেবে প্রস্তুত ছিলাম, আজ তার ফল পেয়েছি।”

পরিসংখ্যান ও রেকর্ড

  • ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম জয় নিউজিল্যান্ডের মাটিতে।
  • শেষ উইকেটে ৫০ রানের জুটি — টেস্ট খেলুড়ে দলের মধ্যে প্রথম ঘটনা।
  • স্যান্টনারের ফিফটি (নম্বর ৮ ব্যাটার হিসেবে) — নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম।
  • চেজ ও সিলসের সম্মিলিত ৬ উইকেট — ক্যারিবিয়ানদের বিদেশে সেরা যৌথ বোলিং পারফরম্যান্সের একটি।

সিরিজের চিত্র: এখন ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

পাঁচ ম্যাচের এই টি-টোয়েন্টি সিরিজে এখন ১-০ তে এগিয়ে রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
আগামীকাল একই ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় ম্যাচ। নিউজিল্যান্ডের লক্ষ্য থাকবে ঘুরে দাঁড়ানো, আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ চাইবে লিড আরও বাড়াতে।

বিশ্লেষণ: ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘নতুন রূপ’

গত কয়েক বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সবাই চিনত “হিট অ্যান্ড মিস” দল হিসেবে — যারা হয়তো একদিন ২৫০ রান তাড়া করে, পরদিন ১০০ রানের নিচে গুটিয়ে যায়।

কিন্তু নতুন কোচ ড্যারেন স্যামির অধীনে দলটি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। ব্যাটিংয়ে এসেছে ধৈর্য, বোলিংয়ে নিয়ন্ত্রণ। বিশেষ করে তরুণ পেসার জেইডেন সিলস, ম্যাথিউ ফোর্ড এবং স্পিনার চেজ দলে ভারসাম্য এনেছেন।

অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের সমস্যা স্পষ্ট — অভিজ্ঞতার ঘাটতি ও মিডল অর্ডারের ভঙ্গুরতা। কেইন উইলিয়ামসন ও সাইফার্টের অনুপস্থিতি দলকে বড্ড শূন্য করে দিয়েছে।

আগামীর চ্যালেঞ্জ

নিউজিল্যান্ড চাইবে আগামী ম্যাচে দলীয় ব্যাটিংয়ে স্থিতি আনতে। রাচিন রবীন্দ্র ও গ্লেন ফিলিপসদের আরও দায়িত্ব নিতে হবে।
অন্যদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ চাইবে এই জয়ের ধারা ধরে রাখতে এবং সিরিজটি আগেভাগে নিজেদের করে নিতে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ২০ ওভারে ১৬৪/৬ (শাই হোপ ৫৩, পাওয়েল ৩৩, চেজ ২৮; ডাফি ২/১৯, ফোকস ২/৩৫)
নিউজিল্যান্ড: ২০ ওভারে ১৫৭/৯ (স্যান্টনার ৫৫*, রবিনসন ২৭, রবীন্দ্র ২১; চেজ ৩/২৬, সিলস ৩/৩২)
ফলাফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা: রোস্টন চেজ।
সিরিজ: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১-০ তে এগিয়ে।

MAH – 13636 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button