রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলাকালীন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহত হন আবুল কালাম আজাদ নামে এক সাধারণ মানুষ। ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত সড়কে ঘটে যাওয়া এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পর ক্ষোভ, শোক ও প্রশ্নে মুখর হয়ে উঠেছে পুরো দেশ।
ঘটনার পরপরই নিহত কালামের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ও একজন সদস্যকে মেট্রোরেলে স্থায়ী চাকরি দেয়ার দাবিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)-এর বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
আইনি নোটিশ পাঠালেন আইনজীবী এনামুল হক নবীন
ঢাকা জজ কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী এনামুল হক নবীন মঙ্গলবার ডাকযোগে এই লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। নোটিশটি প্রেরণ করা হয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব/সিনিয়র সচিব এবং ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, ৩০ দিনের মধ্যে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং কালামের পরিবারের একজন সদস্যকে মেট্রোরেলে স্থায়ী চাকরি দিতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়।
দুর্ঘটনার মর্মান্তিক মুহূর্ত
২০২৫ সালের ২৬ অক্টোবর, দুপুরের দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেল লাইন-৬ এর পিয়ার নম্বর ৪৩৩ থেকে হঠাৎ দুইটি বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে যায়। এর মধ্যে একটি প্যাড নিচ দিয়ে হাঁটতে থাকা পথচারী আবুল কালাম আজাদের মাথায় আঘাত করলে তিনি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।
সাধারণ মানুষ, সহকর্মী এবং পথচারীরা স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে ভিড় জমে যায়। পরে স্থানীয় পুলিশ ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে।
নিহত আবুল কালাম আজাদ: পরিবারের একমাত্র ভরসা
আবুল কালাম আজাদ ছিলেন এক পরিশ্রমী, সৎ ও নিরহংকার মানুষ। রাজধানীতে তিনি ছোটখাটো একটি চাকরি করতেন। তার আয়েই চলত পরিবারের সব খরচ।
কালামের স্ত্রী এবং দুটি ছোট শিশু সন্তান রয়েছে। এছাড়া তার ছোট ভাই এখনো পড়াশোনা করছেন, যার খরচও বহন করতেন কালাম নিজেই।
পরিবারের সদস্যরা এখন একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। এক মুহূর্তে পরিবারের আশ্রয় ও ভরসা হারিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
‘চরম অব্যবস্থাপনার ফল’ — নোটিশে অভিযোগ
আইনি নোটিশে বলা হয়,
“ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড তাদের স্থাপনা ও যন্ত্রাংশের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিয়ারিং প্যাডের মতো ভারী ও গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম কোনো রকম সতর্কতা ছাড়া জনবহুল এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে স্থাপন করা হয়েছিল। এটি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের মারাত্মক গাফিলতি এবং অব্যবস্থাপনার ফল।”
নোটিশে আরো উল্লেখ করা হয়, এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দ্রুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং সকল ঝুঁকিপূর্ণ অংশ পরিদর্শনের দাবি জানানো হয়।
প্রথমে ৫ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব, কিন্তু পরিবারে ক্ষোভ
দুর্ঘটনার পরদিন ২৭ অক্টোবর মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ নিহত কালামের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানায় এবং ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ও একজনকে চাকরি দেয়ার প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু নিহতের পরিবার ও আইনজীবী এই প্রস্তাবকে “অবাস্তব, অপমানজনক এবং মানবিকতার পরিপন্থী” বলে মন্তব্য করেছেন।
আইনজীবী এনামুল হক নবীন বলেন—
“একজন কর্মক্ষম, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে মাত্র পাঁচ লাখ টাকা কোনোভাবেই যথাযথ ক্ষতিপূরণ নয়। এটা কোনো মানবিক সহায়তাও নয়, বরং একধরনের অবমূল্যায়ন।”
আইনি নোটিশের দাবি: ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ও স্থায়ী চাকরি
নোটিশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,
“আবুল কালাম আজাদের মৃত্যু সরাসরি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে ঘটেছে। তার পরিবার এখন আর্থিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাই ন্যূনতম ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাদের ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ এবং একজন সদস্যকে স্থায়ী চাকরি দিতে হবে।”
যদি ৩০ দিনের মধ্যে এই দাবি পূরণ না হয়, তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
বাংলাদেশে মেট্রোরেল প্রকল্পটি ঢাকার যানজট নিরসনে এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রকল্প এলাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।
এর আগে ২০২২ সালে মেট্রোরেলের কাজ চলাকালীন ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে এক পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহত হয়েছিলেন। সেই সময়ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল।
তবুও নিরাপত্তার ঘাটতি থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়নি—এমন অভিযোগ উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন—
“প্রতিদিন হাজারো মানুষ এই এলাকাগুলো দিয়ে হেঁটে যায়। তবুও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। এটা অবহেলার চরম উদাহরণ।”
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিক্রিয়া
দেশের বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, সরকার ও প্রকল্প কর্তৃপক্ষের উচিত নিহতের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন—
“একজন সাধারণ নাগরিকের জীবন কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের চেয়ে কম মূল্যবান নয়। যেভাবে অব্যবস্থাপনার কারণে প্রাণহানি ঘটছে, তা রাষ্ট্রের দায় এড়ানো যায় না।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত: নিরাপত্তা প্রটোকল কঠোর করতে হবে
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা বলছেন, ভারী অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে নিয়মিত পরিদর্শন, যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
একজন প্রকৌশলী বলেন—
“বিয়ারিং প্যাড পড়া মানে নির্মাণকাজে বড় ধরনের ত্রুটি। এটা শুধু মানবিক ভুল নয়, বরং প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা। দায় অবশ্যই প্রকল্প পরিচালনাকারী সংস্থার।”
পরিবারের আর্তনাদ: ‘আমরা বিচার চাই’
নিহতের স্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে বলেন—
“আমার স্বামী প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করতেন আমাদের জন্য। এখন আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমি শুধু চাই, যেন এমন দুর্ঘটনায় আর কোনো পরিবার স্বজন হারায় না।”
তার কণ্ঠে বেদনা, প্রতিবাদ ও অসহায়ত্বের মিশ্র সুর—
“আমরা টাকা চাই না, ন্যায়বিচার চাই। কিন্তু যদি সরকার আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, আমরা পথে বসে যাব।”
সরকার ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের অবস্থান
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা বিষয়টি তদন্ত করছে এবং নিহতের পরিবারকে যথাযথ সহায়তা দেওয়া হবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন—
“এই দুর্ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। যাদের গাফিলতি প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
দুর্ঘটনার পর জনসচেতনতা বাড়ানোর দাবি
রাজধানীর নাগরিক সমাজের দাবি, উন্নয়ন প্রকল্পে মানুষের নিরাপত্তা সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। মেট্রোরেল যেমন উন্নয়নের প্রতীক, তেমনি তা যেন কারও জীবনের জন্য হুমকি না হয়।
একজন নাগরিক কর্মী বলেন—
“যত উন্নয়নই হোক, যদি সাধারণ মানুষ নিরাপদে না থাকে, তবে সেই উন্নয়ন অর্থহীন।”
আবুল কালাম আজাদের মৃত্যু একটি মর্মস্পর্শী উদাহরণ—কীভাবে একটি ক্ষণিকের অবহেলা পুরো একটি পরিবারকে নিঃস্ব করে দিতে পারে।
দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যেমন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আশার আলো, তেমনি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এগুলোকে পরিণত করছে ভয়াবহ বিপর্যয়ে।
আজ প্রয়োজন শুধু একটি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া নয়, বরং এমন দুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
মানুষের জীবন সবচেয়ে মূল্যবান—এই বার্তাই যেন এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকার ও কর্তৃপক্ষের কাছে স্পষ্টভাবে পৌঁছে যায়।
MAH – 13521 I Signalbd.com



