মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সুবিধা নিতে চাচাকে ‘বাবা’ দেখিয়ে চাকরি নেয়ার অভিযোগ তদন্তে দুদক, শিগগিরই ডিএনএ পরীক্ষা
মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধা নিতে নিজের চাচাকে পিতা পরিচয়ে উপস্থাপন করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার অভিযোগ উঠেছে নাচোল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তার ডিএনএ পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তের অংশ হিসেবে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে শিগগিরই এই ডিএনএ টেস্ট সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে।
ঘটনার বিস্তারিত
দুদকের মহাপরিচালক আখতার হোসেন মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, নাচোল উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামাল হোসেন মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধা পেতে নিজের জন্মদাতা পিতা-মাতার পরিবর্তে চাচা ও চাচিকে পিতা-মাতা হিসেবে উল্লেখ করে প্রতারণার মাধ্যমে বিসিএসে যোগদান করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দুদক সূত্র জানায়, প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় কমিশন ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত পারিবারিক সম্পর্ক যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমিশনের অনুমোদন অনুযায়ী, ইউএনও কামাল হোসেনসহ তার জন্মদাতা পিতা-মাতা এবং অভিযুক্ত চাচা-চাচির ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নমুনা সংগ্রহের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, কামাল হোসেন ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আবেদন করেন। আবেদন ফর্মে তিনি তার চাচা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আহসান হাবীবকে পিতা হিসেবে এবং চাচি মোছা. সানোয়ারা খাতুনকে মাতা হিসেবে দেখান। ফলে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধা পেয়ে তিনি প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পান।
এর আগে ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, সরকারি চাকরি এবং বিভিন্ন সরকারি সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রেও একই ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করেছেন। তদন্তে এসব তথ্যের সত্যতা পাওয়ার পর দুদক বিষয়টি আরও গভীরভাবে অনুসন্ধানে নামে।
দুদকের অবস্থান ও পরবর্তী পদক্ষেপ
দুদকের মহাপরিচালক বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা কোটার অপব্যবহার একটি গুরুতর অপরাধ। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে ডিএনএ টেস্টের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আদালতের অনুমতি পেলেই পরীক্ষা সম্পন্ন করা হবে।”
দুদক আরও জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা নেওয়ার ঘটনায় একাধিক মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এই ঘটনাকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। কমিশন বলেছে, তদন্তে প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চাকরি বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার অপব্যবহার নিয়ে বিতর্ক
বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটার উদ্দেশ্য ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সন্তান ও পরিবারকে সম্মান জানানো এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই কোটার অপব্যবহার নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নয়—এমন ব্যক্তিরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে সুবিধা নিচ্ছেন।
প্রশাসন ক্যাডারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে কেউ প্রতারণার মাধ্যমে প্রবেশ করলে তা কেবল চাকরি ব্যবস্থাকেই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই দুদকের এই উদ্যোগকে অনেকেই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
প্রশাসন বিশ্লেষক ও সাবেক সচিব ড. মো. ফজলুল হক বলেন, “যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তবে এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রতারণা নয়; বরং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গের সমান। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সত্য উদঘাটন হলে ভবিষ্যতে অন্য কেউ যেন এমন সাহস না পায়, সেটিও নিশ্চিত হবে।”
ইউএনও কামাল হোসেনের বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে মো. কামাল হোসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার ইউএনও হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি মাগুরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সিনিয়র সহকারী কমিশনার এবং নওগাঁর আত্রাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার প্রশাসনিক পদ থেকে অপসারণসহ চাকরিচ্যুতির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত দুদকের তদন্ত শেষ না হওয়ায় তিনি নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন।
দুদকের এই তদন্ত বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার মর্যাদা ও ন্যায়বিচার রক্ষায় এই ধরনের তদন্ত ভবিষ্যতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে শেষ পর্যন্ত ডিএনএ টেস্টের ফলাফল কী আসে, সেটিই নির্ধারণ করবে অভিযোগের ভাগ্য।
এম আর এম – ২০৮১,Signalbd.com



