মাত্র পাঁচ বছর আগে হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন আবদুল্লাহ। নতুন পরিচয়ে জীবন গড়ার সংগ্রামে থাকলেও, শেষ পর্যন্ত একটি নির্মম অভিযোগই কেড়ে নেয় তাঁর জীবন। ‘গরু চুরির’ সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলের নিথর দেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা আয়েশা আক্তার।
ঘটনার বিস্তারিত: রাতে ডাকা হয়, সকালে পাওয়া যায় নিথর দেহ
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার একটি গ্রামে বসবাস করতেন আবদুল্লাহ। তিনি পূর্বে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং তার পুরনো নাম ছিল গৌরব সাহা। ২০১৯ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম পরিবর্তন করে আবদুল্লাহ রাখেন।
গত মঙ্গলবার রাতে তাকে গ্রামের কিছু যুবক একটি জরুরি বিষয়ে কথা বলার নাম করে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর গভীর রাতে স্থানীয় একটি স্কুল মাঠে তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। সকাল বেলা এলাকাবাসী তার মরদেহ রাস্তার পাশে দেখতে পায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে এবং তা ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়।
আবদুল্লাহর ধর্মান্তর ও নতুন জীবন
আবদুল্লাহর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ বছর আগে তিনি স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তিনি একটি ছোট দোকান চালু করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন এবং ধর্মীয় নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে পালন করতেন। তার মা আয়েশা আক্তার বলেন, “ছেলে ইসলাম গ্রহণ করার পর আরও ভালো মানুষ হয়ে উঠেছিল। কারও ক্ষতি করেনি। তাহলে কেন এমন পরিণতি হলো?”
ধর্ম পরিবর্তন করার কারণে সমাজের কিছু মানুষ তার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন বলে পরিবার দাবি করেছে।
‘গরু চোর’ সন্দেহ না পূর্বপরিকল্পিত হত্যা?
নিহতের আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, গ্রামে সম্প্রতি একটি গরু চুরির ঘটনা ঘটে। সেটির কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াই আবদুল্লাহকে সন্দেহ করা হয়। এলাকাবাসীর একাংশের মতে, এটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড — ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তাকে টার্গেট করা হয়ে থাকতে পারে।
স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, “গরু চুরির অভিযোগে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই একজন মানুষকে মেরে ফেলা খুবই দুঃখজনক। আবদুল্লাহ কোনো অপরাধ করেনি, তার ধর্মান্তরই হয়তো তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কারণ হয়েছে।”
পরিবারের দাবি ও আইনি অবস্থান
আবদুল্লাহর মা আয়েশা আক্তার জানান, “আমার ছেলে কোনো গরু চুরি করেনি। তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।” তিনি বলেন, ধর্ম পরিবর্তন করার পর থেকেই ছেলের ওপর সামাজিক চাপ ছিল। কেউ কেউ গোপনে হুমকিও দিত।
পুলিশ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত কয়েকজন সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে এটি গণপিটুনির ঘটনা হিসেবেই তদন্ত করা হচ্ছে। তবে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক কিছু যোগসূত্র রয়েছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গাজীপুর জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করছি এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। অপরাধীরা কেউ রেহাই পাবে না।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই এই ধরনের ঘটনার ন্যায়বিচার দাবি করছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন, “ধর্মান্তর কি আজও অপরাধ?” মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, “এটি শুধু একটি ব্যক্তি হত্যা নয়, বরং সমাজে বিদ্যমান অসহিষ্ণুতার আরেকটি উদাহরণ। ধর্মীয় স্বাধীনতা সাংবিধানিক অধিকার, এবং সেটি রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।”
অতীতেও এমন ঘটনার নজির আছে
এটি প্রথম নয় যে বাংলাদেশে ধর্মান্তরিত কোনো ব্যক্তি সামাজিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। গত কয়েক বছরে একাধিক ধর্মান্তরিত ব্যক্তি হামলার শিকার হয়েছেন — কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো সামাজিক অজ্ঞতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সময় এসেছে এই বিষয়ে রাষ্ট্র ও সমাজকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে।
একটি মৃত্যুর প্রশ্ন, একটি সমাজের দায়
আবদুল্লাহ কি শুধুই ‘গরু চোর’ সন্দেহে নিহত, নাকি তিনি ধর্মান্তরের শাস্তি পেয়েছেন? তার মৃত্যু আমাদের সমাজকে একটি কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে — আমরা কি সত্যিই সব ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা মেনে নিতে প্রস্তুত?
এখন দেখার বিষয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয় এবং এই ঘটনার পর সমাজ কতটা পরিবর্তন হয়।
এম আর এম – ০৫১০, Signalbd.com



