আঞ্চলিক

পঞ্চগড়ে হঠাৎ ঝড়ে শতাধিক ঘরবাড়ি লণ্ডভণ্ড, বিদ্যুৎবিহীন ১১ ঘণ্টা

পঞ্চগড়ে হঠাৎ হওয়া এক দুর্যোগপূর্ণ ঝড়ে মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যেই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। উপড়ে পড়েছে শতবর্ষী বট-পাকুর গাছ, বিদ্যুৎহীন অবস্থায় কাটাতে হয়েছে অন্তত ১১ ঘণ্টা। গতকাল সোমবার রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে বয়ে যাওয়া তীব্র ঝড় ও মুষলধারে বৃষ্টিতে জেলার সদর ও বোদা উপজেলার বহু গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঘরবাড়ি ভাঙন, গাছ উপড়ে সড়ক বন্ধ

ঝড়ের আঘাতে পঞ্চগড় শহর, সদর উপজেলার ধাক্কামারা ও মাগুরা ইউনিয়ন এবং বোদা উপজেলার বেংহারী বনগ্রাম ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুধু বোদা উপজেলার চারটি গ্রামেই শতাধিক বাড়িঘর সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ভেঙে পড়েছে।

পঞ্চগড় পৌরসভার মসজিদপাড়া, কামাতপাড়া, ডোকরোপাড়া, রামেরডাঙ্গা, রাজনগড় (নতুনবস্তি), ধাক্কামারা ইউনিয়নের বুড়িরবান, মালাদাম, মাগুরা ইউনিয়নের সিপাইপাড়া, বোদা উপজেলার শিকারপুর, তেলিপাড়া, জগন্নাথপাড়া ও ডাঙ্গাপাড়া এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা ক্ষয়ক্ষতির চিত্র

মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পঞ্চগড় শহরের চৌরঙ্গী মোড় এলাকায় সদর উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার কার্যালয়ের পাশে একটি বড় কাঁঠালগাছ পড়ে গিয়ে সীমানাপ্রাচীর ভেঙে গেছে। ধাক্কামারা ইউনিয়নের বুড়িরবান এলাকায় একটি বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ে রয়েছে পঞ্চগড়-মালাদাম সড়কে, যার ফলে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পথচারীরা বিকল্প হিসেবে পাশের একটি সুপারিবাগান দিয়ে চলাচল করছেন।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে একই এলাকার প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো দুইটি বট-পাকুর গাছ উপড়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক প্রসন্ন কুমার রায় জানান, ‘এই বট ও পাকুর গাছ দুটি আমাদের পূর্বপুরুষরা ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে দিয়ে রোপণ করেছিলেন। প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক এই গাছ দুটি মাত্র ৩০ মিনিটের ঝড়ে উপড়ে গেছে, যা আমাদের জন্য মানসিকভাবে কষ্টদায়ক।’

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত

মাগুরা সিপাইপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের একটি টিনশেড ভবনের ঘর ঝড়ের তাণ্ডবে উড়ে গিয়ে পড়ে পাশের একটি ভুট্টাখেতে। স্কুল ভবনের বারান্দায় একটি গাছ ভেঙে পড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা আইজুল ইসলাম, আবদুল মোতালেব, ফয়জুল ইসলাম, পুহাতু মোহাম্মদ ও তবিবর রহমানের ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধসে পড়েছে।

গাছ পড়ে বিদ্যুৎ খুঁটি ছিন্ন, বিভ্রাট ১১ ঘণ্টা

ঝড়ের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থায়। নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি পিএলসি (নেসকো)-এর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী সত্যজিৎ দেব শর্মা জানান, অন্তত তিনটি এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি মাটিতে শুয়ে গেছে। সেই সঙ্গে গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে যাওয়ায় একাধিক এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাত থেকেই কর্মীরা মেরামতের কাজে নেমেছেন।

তিনি আরও জানান, ‘সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যেখানে বড় গাছ খুঁটির ওপর পড়ে গেছে, সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ আপাতত বন্ধ রেখে অন্য এলাকাগুলোতে ধাপে ধাপে সংযোগ পুনরায় চালু করা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে।’

ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় স্থানীয় উদ্যোগ

বোদা উপজেলার বেংহারী বনগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেব আলী বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের অন্তত চারটি গ্রামে শতাধিক ঘরবাড়ি ঝড়ে ভেঙে গেছে। অনেক গাছপালা পড়ে আছে মানুষের ঘরের ওপর কিংবা রাস্তায়। আজ সকাল থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে গাছ সরানোর কাজ চলছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।’

প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ

স্থানীয়রা বলছেন, এই ঝড় তাদের মনে করিয়ে দিয়েছে দুর্যোগে প্রস্তুতির ঘাটতির বাস্তবতা। অনেক পরিবার এখনও খোলা আকাশের নিচে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জরুরি সহায়তা দেওয়া না হলে তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ব্যাখ্যা

আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের উপর দিয়ে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব এবং আকস্মিক কালবৈশাখীর কারণে এই ঝড় সৃষ্টি হয়। গত কয়েকদিন ধরেই উত্তরের আকাশে ঘন মেঘ জমছিল এবং সোমবার রাতেই তা ঝড়ের রূপ নেয়। তবে পূর্বাভাস যথাযথভাবে জানানো হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন এলাকাবাসী।

পঞ্চগড়ের এই হঠাৎ ঝড় দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির তাণ্ডব কতটা ভয়াবহ হতে পারে মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যেই। শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি ধ্বংস, শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী গাছ উপড়ে যাওয়া, বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষয়ক্ষতি প্রমাণ করে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি প্রস্তুতি ও দ্রুত পুনর্বাসন কর্মসূচি দরকার।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button