অর্থনীতি

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি: রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি

Advertisement

অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) প্রকাশিত সর্বশেষ ত্রৈমাসিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনাতে দেখা গেছে, রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।

তবে একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি মন্থর, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে, এবং বিনিয়োগের গতি শ্লথ হয়েছে। এমসিসিআই মনে করে, এগুলো বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বড় বাধা হয়ে আছে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি

২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৪.৮৬ শতাংশে, যা দ্বিতীয় প্রান্তিকে ছিল ৪.৪৮ শতাংশ। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, প্রবৃদ্ধি ধীর হলেও অর্থনীতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছে।

মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে জুন মাসে হার কিছুটা কমে হয়েছে ৮.৪৮ শতাংশ। তবে পুরো অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০.০৩ শতাংশ, যা সরকারের সহনীয় মাত্রার অনেক বেশি।

রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮.৫৮ শতাংশ বেশি

রপ্তানি আয়ের খাতভিত্তিক চিত্র—

  • পোশাক খাত: প্রধান রপ্তানি আয়কারী খাত হিসেবেই রয়েছে।
  • চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য: আয় ১.১৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
  • কৃষিপণ্য: আয় ৯৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
  • হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ: আয় ৪৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার

পোশাকশিল্পে নতুন বাজার খোঁজা, পণ্যের মানোন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া চালুর কারণে প্রবৃদ্ধি টেকসই হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) প্রবাহে রেকর্ড বৃদ্ধি

প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬.৮৩ শতাংশ। মোট আয় দাঁড়িয়েছে ৩০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

বিশেষজ্ঞদের মতে—

  • মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
  • আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো সহজতর করা
  • হুন্ডি কমে যাওয়া

—এসব কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে।

আমদানি প্রবণতা ও মূলধনি যন্ত্রপাতি খাতে ধীরগতি

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে মোট আমদানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩.৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা প্রবৃদ্ধি হিসেবে ৫.৩১ শতাংশ। তবে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে।

এমসিসিআই মনে করে—

  • শিল্প সম্প্রসারণে ধীরগতি
  • নতুন বিনিয়োগে অনীহা
  • উচ্চ সুদের হার

—এসব কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির হার হ্রাস পেয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে।

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির দুর্বলতা

বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি মন্থর হওয়াকে এমসিসিআই একটি বড় কাঠামোগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং উচ্চ সুদের কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে অনাগ্রহী হচ্ছেন।

ব্যাংকিং খাতের সংকট ও সংস্কারের প্রয়োজন

এমসিসিআই বলছে, ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের সমস্যা—

  • নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘাটতি
  • ব্যাপক ঋণ অনিয়ম
  • স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব

—এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করা না হলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ঝুঁকিতে পড়বে। এজন্য আর্থিক সুশাসন উন্নয়নজনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া অপরিহার্য।

রাজস্ব আদায় ও ঘাটতি

২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর আদায় দাঁড়িয়েছে ৩,৭০,৮৭৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২.২৩ শতাংশ বেশি। তবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি হয়েছে ১৯.৯৮ শতাংশ

খাতভিত্তিক রাজস্ব—

  • ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) — প্রবৃদ্ধি থাকলেও লক্ষ্য অর্জিত হয়নি
  • শুল্ক কর — সামান্য বৃদ্ধি
  • আয়কর — প্রত্যাশার চেয়ে কম

টাকার মান ও বিনিময় হার

মার্কিন ডলারের বিপরীতে দেশীয় টাকার মান কমেছে ৩.৮৯ শতাংশ। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১১৮ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২২.৭৭ টাকা। এতে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, তবে রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়তে সহায়ক হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

এমসিসিআই মনে করে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে হলে—

  1. বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ
  2. অবকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা
  3. আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য বজায় রাখা
  4. ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন
  5. শিল্পে বৈচিত্র্য আনা এবং নতুন বাজারে প্রবেশ

—এসব পদক্ষেপ জরুরি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক ধরনের সংক্রমণ পর্যায়ে রয়েছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি স্বস্তির বার্তা দিলেও বিনিয়োগ স্থবিরতা, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং মূল্যস্ফীতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।

যদি সরকার ও বেসরকারি খাত সমন্বিতভাবে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারে, অবকাঠামো উন্নয়নে গতি আনে এবং ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কার্যকরভাবে সম্পন্ন হয়—তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরও স্থিতিশীল ও প্রবৃদ্ধিমুখী হতে পারে।

MAH – 12283 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button