
ছোট্ট সাফরিনের লড়াই: প্লাটিলেট নেমে মাত্র এক হাজারে
নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ এলাকার সজীব হোসেনের শিশুকন্যা সানজিদা আক্তার সাফরিনের বয়স মাত্র কয়েক বছর। পরিবারের আদরের এই শিশুটি সম্প্রতি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। প্রথমে জ্বর ও বমি শুরু হলেও হঠাৎ করেই অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে। এক রাতে শরীর দুর্বল হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছোট্ট সাফরিন। বাবা-মা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জানান, তার রক্তে প্লাটিলেট নেমে গেছে মাত্র এক হাজারে— যা জীবনহানির আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
বর্তমানে ডিএনসিসি ডেডিকেটেড হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা শেষে তার প্লাটিলেট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজারে। পরিবার কিছুটা স্বস্তি পেলেও এখনো পুরোপুরি নিশ্চিন্ত নয়। সাফরিন পড়ে ২৯ নং আদর্শ বালক ও বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণিতে। বাবা সজীব হোসেন বলেন—
“মেয়ের জ্বর, বমি, এমনকি বমির সঙ্গে রক্ত যাচ্ছিল। আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। আল্লাহর রহমতে এখন অনেকটা সুস্থ হয়েছে।”
সারাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ চিত্র
শুধু সাফরিন নয়— দেশের হাজারো পরিবারই ডেঙ্গুর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৪১ হাজার ৮৩১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন অন্তত ১৭৯ জন।
শুধু ২১ সেপ্টেম্বর একদিনেই ৭৭৪ জন নতুন রোগী ভর্তি এবং ১২ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ডিএনসিসি ডেডিকেটেড হাসপাতালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৭,৮১২ জন রোগী, যার মধ্যে মারা গেছেন ৯২ জন।
কোন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে—
- বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত: ১২,১৭০ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগে: ৬,৪১২ জন
- ঢাকা বিভাগে: ৬,১০৭ জন
- রাজশাহী বিভাগে: ২,৮১৬ জন
- খুলনা বিভাগে: ২,১৩১ জন
- ময়মনসিংহ বিভাগে: ৮৬৫ জন
- রংপুর বিভাগে: ২৮১ জন
- সিলেট বিভাগে: ১২৩ জন
ঢাকার মধ্যেও বড় পার্থক্য রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে আক্রান্ত ৬,৪৫৬ জন আর উত্তর সিটিতে আক্রান্ত ৪,৪৭০ জন।
হাসপাতালে রোগীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা
ডিএনসিসি হাসপাতালে ভর্তি রিয়া মনি নামের ৮ বছরের এক শিশু পাঁচ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছে। তার বাবা রুবেল আহমেদ জানান, প্রথমে নাপা খাওয়ালে জ্বর কমলেও পরে আবারও জ্বর ওঠে এবং পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে।
অন্যদিকে উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা মো. সুমন আখন্দ (৪৫) জানান, প্রচণ্ড পেটব্যথা ও বমির কারণে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তিনি বলেন—
“তিন দিন জ্বর ছিল। এখন জ্বর কমেছে, তবে পেটে ব্যথা যাচ্ছে না।”
চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ
ডিএনসিসি হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. এস এম হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তার মতে—
“ডেঙ্গু খুব জটিল রোগও নয়, আবার অবহেলা করলে প্রাণঘাতীও হতে পারে। অনেক যুবক জ্বরকে গুরুত্ব দেন না। পরে অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে আসেন।”
তিনি পরামর্শ দেন—
- জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা— এসব উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে পরীক্ষা করতে হবে।
- সময়মতো চিকিৎসা নিলে সুস্থ হওয়া সম্ভব।
- সচেতনতার অভাবেই রোগীর মৃত্যু ঘটছে।
গ্রামে ডেঙ্গুর বিস্তার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরের তুলনায় গ্রামে ডেঙ্গু বিস্তারের পেছনে রয়েছে কয়েকটি বড় কারণ—
- বর্ষার পানি জমে থাকা – পুকুর, খালি ড্রাম, টায়ার বা খোলা জায়গায় পানি জমে মশার প্রজনন বেড়ে যায়।
- স্প্রে ও ফগিংয়ের অভাব – সিটি কর্পোরেশনে নিয়মিত স্প্রে করা হলেও গ্রামে এসব ব্যবস্থা নেই।
- সচেতনতার ঘাটতি – অনেকেই ডেঙ্গুর উপসর্গ চিনতে পারেন না, ফলে দেরিতে চিকিৎসা নেন।
কুমিল্লার এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন—
“ডেঙ্গুর লক্ষণ শুরু হয় উচ্চ জ্বর দিয়ে। অনেক সময় ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা যায়। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা থাকে। এসব দেখলেই পরীক্ষা করা জরুরি।”
প্লাটিলেট ও ডেঙ্গুর ঝুঁকি
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, সাধারণত সুস্থ মানুষের রক্তে ১,৫০,০০০ থেকে ৪,৫০,০০০ প্লাটিলেট থাকে। ডেঙ্গু হলে তা দ্রুত কমে যায়।
- ১ লাখের নিচে নেমে গেলে বিপদ বাড়ে
- ২০ হাজারের নিচে গেলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি মারাত্মক হয়
- সাফরিনের মতো যদি ১ হাজারে নেমে যায়, তবে তা জীবনসংকট তৈরি করে
প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়
বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন—
- আশেপাশে জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখা
- ফুলদানি, টব, ড্রাম, পুরনো টায়ার ইত্যাদি খালি করে শুকনো রাখা
- বাসায় মশারি ব্যবহার করা
- সন্ধ্যার পর মশার কয়েল বা ইলেকট্রিক মেশিন ব্যবহার করা
- শরীর ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরা
সমাজ ও অর্থনীতিতে প্রভাব
ডেঙ্গু শুধু স্বাস্থ্য নয়, দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। হাসপাতালে ভর্তি, ওষুধ, চিকিৎসা, কর্মক্ষমতা হ্রাস— সব মিলিয়ে লাখো পরিবার আর্থিক চাপের মুখে পড়ছে। শ্রমজীবী মানুষ কয়েকদিন কর্মহীন হলে পুরো পরিবার অনিশ্চয়তায় ভোগে।
ছোট্ট সাফরিনের মতো হাজারো শিশু ও পরিবার আজ ডেঙ্গুর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন— সচেতনতা, সময়মতো চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই ডেঙ্গু থেকে বাঁচার মূল উপায়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরও জোরালো পদক্ষেপ না নিলে প্রতিবছরই এই ভয়াবহতা বাড়তে থাকবে।
MAH – 12978 I Signalbd.com