অর্থনীতি

২৪ দিনে এল ২৭০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়

বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের ধারা শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে। চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম ২৪ দিনে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে পাঠিয়েছেন ২৭০ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রবাসী আয়ের রেকর্ড বৃদ্ধির কারণ

বিশ্লেষকদের মতে, গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় এবং অর্থ পাচার হ্রাস পাওয়ায় প্রবাসীরা এখন বৈধ পথেই বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন। একই সঙ্গে রমজান মাস ও আসন্ন ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে দেশে পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে প্রবাসীরা অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, ফেব্রুয়ারি মাসে মোট প্রবাসী আয় এসেছিল ২৫২ কোটি ডলার, যেখানে মার্চ মাসের প্রথম ২৪ দিনেই এই পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে।

রমজান মাসে প্রবাসী আয়ের উল্লম্ফন

সাধারণত দুই ঈদের আগে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি প্রবাহিত হয়। ২০২৪ সালের ঈদুল ফিতরের আগে মাত্র পাঁচ দিনে ৪৫ কোটি ডলার দেশে এসেছিল, অর্থাৎ দিনে গড়ে ৯ কোটি ডলার। কিন্তু এবারের রমজানে সেই ধারা আরও শক্তিশালী হয়েছে।

চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন ১১ কোটি ডলার করে এসেছে, দ্বিতীয় সপ্তাহে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ কোটি ডলারে। পরবর্তী চার দিনে প্রবাসীরা প্রতিদিন গড়ে ১৫ কোটি ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।

বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বৃদ্ধি

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বর্তমান সরকারের কঠোর পদক্ষেপের ফলে হুন্ডির মতো অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা কমে এসেছে। ফলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলেই টাকা পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন।

একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকেও প্রবাসীদের জন্য আকর্ষণীয় রেমিট্যান্স সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে, যা বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর হার বাড়িয়েছে।

ডলার সংকট কমছে, স্থিতিশীল হচ্ছে বিনিময় হার

প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের ব্যাংকিং খাতে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে, ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলা ডলার সংকট অনেকটাই কেটে গেছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ১২৩ টাকার মধ্যেই ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় সংগ্রহ করছে, যা বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছে।

গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ৩% এবং ১৭% বেশি। মার্চ মাসে এই বৃদ্ধির হার আরও উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বছরের পরিসংখ্যান: প্রবাসী আয়ের উর্ধ্বগতি

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশে এসেছে ১,৮৪৯ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪% বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ১,৪৯৩ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসের প্রথম ১৫ দিনে দেশে এসেছে ১৬৬ কোটি ডলার, যা ১৯ মার্চে বেড়ে হয় ২২৫ কোটি ডলার। শুধুমাত্র ১৯ মার্চ একদিনেই এসেছে ১৩ কোটি ডলার। ২২ মার্চ পর্যন্ত এই পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪৩ কোটি ডলারে, যা ২৪ মার্চে ২৭০ কোটি ডলারে পৌঁছায়।

ব্যাংকগুলোর প্রতিযোগিতা কমছে, ডলার দর নিয়ন্ত্রণে

আগে ব্যাংকগুলোর মধ্যে রেমিট্যান্সের ডলার কেনার জন্য প্রতিযোগিতা তীব্র ছিল, যা বাজারে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এই প্রতিযোগিতা অনেকটাই কমেছে, ফলে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রিত রয়েছে।

একসময় প্রতি ডলারের দাম ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল, তবে বর্তমানে তা ১২৩ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে আমদানির জন্য ডলারের খরচও কমে এসেছে।

প্রবাসী আয় দেশের অর্থনীতির জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?

প্রবাসী আয় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রধান উৎস। এই আয়ের বিপরীতে কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না, কারণ এটি সরাসরি দেশে প্রবাহিত হয়।

অন্যদিকে, রপ্তানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও এর জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়, যা আবার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের কারণ হয়।

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিশোধেও ডলারের প্রয়োজন হয়। তাই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হয় এবং বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা সহজ হয়।

আগামী দিনের প্রত্যাশা

বিশ্লেষকরা আশা করছেন, চলতি মার্চ মাসের শেষ নাগাদ মোট প্রবাসী আয় ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

প্রবাসী আয় বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে। তবে সরকারের উচিত প্রবাসীদের আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া, যাতে তারা ভবিষ্যতেও বৈধ উপায়ে অর্থ পাঠাতে উৎসাহী হন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button