
বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসের অন্যতম বড় সাইবার চুরি মামলায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। ফিলিপাইনের আরসিবিসি (RCBC) ব্যাংকের জুপিটার শাখা থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এই অর্থটি ২০১৬ সালে নিউইয়র্কে অবস্থিত ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে চুরি হওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অংশ।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) নিশ্চিত করেছেন যে, আদালতের মাধ্যমে সিআইডি এই বড় অংকের অর্থ বাজেয়াপ্ত করেছে।
ঘটনা পরিচিতি: ২০১৬ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক চুরি
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়। এই চুরি জাল SWIFT বার্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে সংঘটিত হয়।
চুরির পর তদন্তে দেখা যায়, এই অর্থের প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু পরে সেটি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় ফেরত আসে। বাকি ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (RCBC) এর মাকাতি সিটি শাখার বিভিন্ন ভুয়া অ্যাকাউন্টে জমা হয়।
এরপর এই অর্থ বিভিন্ন ক্যাসিনো এবং অনলাইন লেনদেনের মাধ্যমে পাচার করা হয়।
সাইবার চুরির ইতিহাস: বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় ক্ষতি
এই চুরি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাইবার ডাকাতি হিসেবে বিবেচিত। ঘটনা বিশ্বজুড়ে সংবাদ শিরোনামে আসে।
চুরির ধরন ছিল প্রযুক্তিনির্ভর ও পরিকল্পিত। জাল SWIFT বার্তার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে চুরি করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, দেশের আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সিস্টেমে আস্থা নষ্ট করার একটি চক্রান্ত।
ফিলিপাইনের আদালতে বিচার
চুরির তদন্তের অংশ হিসেবে ফিলিপাইন সরকার এবং বাংলাদেশের সিআইডি যৌথভাবে তদন্ত চালায়। ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মায়া ডিগুইটো মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে চুরির অর্থ লুকিয়ে রাখা এবং পাচারের চেষ্টা করেছিলেন।
ফিলিপাইনের আদালত পরে সেই ৮১ মিলিয়ন ডলারের জব্দ করার নির্দেশ দেয়।
বাজেয়াপ্ত অর্থের পরবর্তী ধাপ
সিআইডি জানিয়েছে, বাজেয়াপ্ত অর্থ বাংলাদেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অর্থ ফেরত আনা হলে এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ হবে।
অর্থ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরণের পদক্ষেপ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সিস্টেমে আস্থা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
চুরির সময় এবং পরে, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং কমিউনিটি এই ঘটনা সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইনের ব্যাংকিং কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনা প্রমাণ করেছে, প্রচলিত ব্যাংকিং সিস্টেমও সাইবার আক্রমণের কাছে নিরাপদ নয়।
সাইবার নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
বাংলাদেশ ব্যাংক এই চুরির পরে ব্যাংকিং সিকিউরিটি আরও কড়া ও আধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা সজ্জিত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
মূল পদক্ষেপগুলো হচ্ছে:
- আন্তর্জাতিক SWIFT বার্তা সিস্টেমে দুই স্তরের নিরাপত্তা।
- রিয়েল-টাইম ট্রানজেকশন মনিটরিং।
- ব্যাংকিং স্টাফের সাইবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ।
- ফরেনসিক অডিট এবং নিয়মিত নিরাপত্তা যাচাই।
চুরির পর সমাজ ও মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া
২০১৬ সালের চুরির পর দেশজুড়ে সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
বেসরকারি অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ইমেজের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছিল।
তবে, সিআইডি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত অর্থ ফেরত আনার ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা ও তদন্ত ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে।
পুনরুদ্ধারের গুরুত্ব
৮১ মিলিয়ন ডলার ফেরত পাওয়া মানে কেবল অর্থের পুনঃপ্রাপ্তি নয়, এটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিরক্ষা ও আত্মবিশ্বাসের পুনঃস্থাপন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি ভবিষ্যতে সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে।
২০১৬ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি একটি সাইবার আক্রমণ ও অর্থপাচারের ইতিহাসে কালজয়ী ঘটনা। ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার বাজেয়াপ্ত হওয়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই পুনরুদ্ধার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সুনাম ও রিজার্ভ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথে বড় পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
MAH – 12929 I Signalbd.com