জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধন ব্যয় কমল আরও, ঢাকা মহানগরেই খরচ সবচেয়ে বেশি

বাংলাদেশে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের ব্যয় নতুন বাজেট ঘোষণার পর আবারও কমিয়ে আনা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা সহ বড় শহরগুলোতে এই খরচ কিছুটা হলেও কমার ফলে জমি ও আবাসন খাতে সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ে উৎসাহ সৃষ্টি হতে পারে। যদিও ঢাকা মহানগরে জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ব্যয় এখনও দেশের অন্য জায়গার তুলনায় বেশি।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদনের সময় জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন সংক্রান্ত কর এবং ফি কমানো হয়েছে। জমি ও ফ্ল্যাটের মূল্য নির্ধারণে উৎসে কর বা উৎসে কর হার গত কয়েক দফায় ধাপে ধাপে কমানো হয়েছে। এর ফলে ক্রেতাদের নিবন্ধন খরচ ১৫.৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে।
জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনে কর এবং অন্যান্য ফি কমানোর বিস্তারিত
রাজধানী ঢাকার গুলশান, বনানী, মতিঝিল ও তেজগাঁওয়ের মতো মহল্লায় জমি বা ফ্ল্যাট নিবন্ধনে উৎসে কর কমিয়ে ৮ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে আনা হয়েছে। অন্য শহর ও পৌর এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন করও যথাক্রমে কমেছে –
- ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে: ৮% থেকে কমিয়ে ৫%
- অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায়: ৬% থেকে ৩%
- পৌরসভা এলাকায়: ৪% থেকে ২%
এছাড়া জমি বা ফ্ল্যাট নিবন্ধনের সময় স্ট্যাম্প শুল্ক ১.৫%, নিবন্ধন ফি ১%, স্থানীয় সরকার ফি ৩% এবং ভ্যাট ২% থেকে ৪.৫% পর্যন্ত রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, গুলশানের ১ হাজার ৬০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট নিবন্ধনে আগের মতো ১৫.৫ শতাংশ অর্থ খরচ হতো, যা এখন কমে ১২.৫ শতাংশে এসেছে।
উৎসে কর ছাড়ের পেছনের কারণ ও প্রভাব
সরকার জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের কর কমিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ লেনদেন কমাতে চাচ্ছে। জমি-বাজারে কালো অর্থের প্রবাহ রোধে গত কয়েক বছর ধরে সরকারের নানা পদক্ষেপ দেখা গেছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সম্পত্তি নিবন্ধনে উৎসাহ দিতে মূলধনি মুনাফা কর বা উৎসে কর কমানো হয়েছে। গত ২ জুনের প্রস্তাবিত বাজেটে এক দফায় উৎসে কর কমানোর পাশাপাশি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
এনবিআরের জমি শ্রেণি এবং করহার কাঠামো
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০২৩ সাল থেকে ঢাকার জমি ও ফ্ল্যাটগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করেছে, যা মৌজার অবস্থানভেদে ক, খ, গ, ঘ ও ঙ শ্রেণি হিসেবে পরিচিত।
- ‘ক’ শ্রেণির মধ্যে রয়েছে প্রধানত বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা যেমন রাজউক, সিডিএ, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি।
- ‘খ’ শ্রেণিতে রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আবাসিক এলাকা।
- ‘গ’ শ্রেণিতে রয়েছে আবাসন কোম্পানি বা ভূমি উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন বাণিজ্যিক এলাকা।
- ‘ঘ’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে গ শ্রেণির অন্তর্গত আবাসিক এলাকা।
- বাকি জমি ‘ঙ’ শ্রেণিতে থাকে।
এই শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী কর হার নির্ধারণ করা হয়।
আবাসন খাতে কর ছাড় ও সরকারের উদ্দেশ্য
আবাসন খাতের স্বার্থে কর কমানোর ফলে জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন সহজ ও সাশ্রয়ী হবে। এতে ক্রেতারা সম্পত্তি নিবন্ধনের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারবেন।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন,
“নিবন্ধন ব্যয় ৩ শতাংশ কমানো ইতিবাচক পদক্ষেপ। এতে ফ্ল্যাট নিবন্ধনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। তবে আমাদের মনে হয়, নিবন্ধন খরচ ৭-৮ শতাংশে নিয়ে আসা দরকার। ধাপে ধাপে কমালে অধিকাংশ ক্রেতা নিবন্ধন করবেন, ফলে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে।”
অন্যান্য শহরে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধন করের হালনাগাদ
ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন এলাকায় যেমন কমানো হয়েছে, তেমনি গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য শহরেও কর হ্রাস পেয়েছে।
এনবিআর তথ্য অনুযায়ী,
- ‘ক’ থেকে ‘ঘ’ শ্রেণির জমিতে ফ্ল্যাট বা বাণিজ্যিক স্পেসে প্রতি বর্গমিটারে কর ৮০০ টাকা থেকে কমিয়ে এখন ৫ শতাংশ।
- ‘ঙ’ শ্রেণিতে প্রতি বর্গমিটারে কর ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশে নামানো হয়েছে।
এখন জমির মূল্য অনুযায়ী করের বোঝা অনেকটাই কমে এসেছে, যা ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য উপকারী হবে।
নিবন্ধন ব্যয় কমানোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধন খরচ কমানোর ফলে
- জমি-ফ্ল্যাটের লেনদেনে স্বচ্ছতা বাড়বে।
- কালো টাকা লেনদেন কমে আসবে।
- গৃহহীন মানুষের জন্য আবাসন কেনা আরও সহজ হবে।
- বাজারে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে।
- সরকারের রাজস্ব আয় দীর্ঘমেয়াদে বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
সরকারের এই উদ্যোগ দেশের আবাসন খাতকে আরও বিকাশমান ও সুশৃঙ্খল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সুত্র ও বিস্তারিত:
- জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)
- ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন
- রিহ্যাব (আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন)
- ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন সভার তথ্য
- সরকারি প্রজ্ঞাপন ও করহার বিশ্লেষণ
নতুন বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধন কর ও ফি কমানোর ফলে দেশের আবাসন খাতে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হবে। বিশেষ করে ঢাকায় জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ব্যয় কমলেও, অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকা এখনও ব্যয়বহুল অঞ্চল হিসেবে থেকে যাচ্ছে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এই নিবন্ধন ব্যয় আরও কমিয়ে নাগরিকদের জন্য জমি ও আবাসন কেনাকে সহজ করা।
এছাড়া নিয়মতান্ত্রিক লেনদেন বাড়াতে কর ব্যবস্থা আরও স্বচ্ছ এবং গ্রাহক-বান্ধব করা প্রয়োজন। এতে দেশে জমি-বিক্রয়ে আইনগত নিরাপত্তা ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত জরুরি।
সিগনাল বিডি (SignalBD.com) এর পক্ষ থেকে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধন খরচ কমানোর এই আপডেট আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই পদক্ষেপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে জমি-আবাসন খাতের আরও সুসংহত ও স্বচ্ছ পরিবেশ গড়ে উঠবে আশা করি।