অর্থনীতি

চামড়া খাতে খেলাপি ৪৮৪৪ কোটি টাকা

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিনির্ভর খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম চামড়া শিল্প বর্তমানে এক গভীর আর্থিক সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চামড়া শিল্পে ব্যাংকঋণের স্থিতি ছিল ১২ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা পরিণত হয়েছে খেলাপি ঋণে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৮ শতাংশ।

চামড়া খাতে এই বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপির কারণে ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। বিশেষ করে কোরবানির ঈদের সময়ে চামড়া কেনার জন্য যে অতিরিক্ত অর্থায়ন প্রয়োজন হয়, তা পূরণে ব্যাংকগুলোর আগ্রহের ঘাটতি স্পষ্ট।

কমেছে ঋণ বিতরণ, ব্যাহত হয়েছে চামড়া সংগ্রহ

চলতি বছরে ৯টি ব্যাংক চামড়া ক্রয়ের জন্য ২৩২ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দিলেও বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ১২৫ কোটি টাকা। অথচ গত বছর এই অঙ্ক ছিল ২৭০ কোটি, ২০২৩ সালে ২৫৯ কোটি, ২০২২ সালে ৪৪৩ কোটি, এবং ২০২১ সালে ৬১০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে এই অঙ্ক ছিল সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ধারাবাহিকভাবে এই হ্রাস প্রমাণ করে চামড়া খাতের প্রতি ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কমে গেছে।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, পর্যাপ্ত ঋণ না পাওয়ার কারণে চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে পুরো রপ্তানি চেইনে। বিশেষ করে ঈদুল আজহার সময় দেশজুড়ে যে বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়, তার সঠিক সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।

ঋণখেলাপি মানসিকতা প্রধান প্রতিবন্ধক

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, চামড়া খাতে বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফশিল করা ঋণের অনাদায়ী পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকায়। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারদের বক্তব্য অনুযায়ী, অনেক ব্যবসায়ী ঋণ নিলেও তা পরিশোধ করতে চান না। এমনকি ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে পুনঃতফশিলের সুযোগ থাকলেও তা গ্রহণে অনীহা দেখিয়েছেন অনেকেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “ঋণ চাইলে ফেরত দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। না হলে ব্যাংকগুলো কেন ঝুঁকি নেবে?” তিনি জানান, চামড়া খাতে এ বছর ২৩২ কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কতটা বিতরণ হয়েছে তা এখনো বলা যাচ্ছে না।

আর্থিক সহায়তার অভাবে ক্ষতির মুখে উদ্যোক্তারা

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, “চামড়া পচনশীল পণ্য হওয়ায় দ্রুত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু নগদ অর্থ না থাকায় এ প্রক্রিয়ায় আমরা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছি।” তিনি জানান, ট্যানারি মালিকদের চাহিদা ছিল ৩০০-৩৫০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ, কিন্তু দেওয়া হয়েছে মাত্র ১২৫ কোটি, যা যথেষ্ট নয়।

চামড়া আড়তদার নুর ইসলাম বলেন, “ঈদুল আজহার সময় সংগ্রহ করা চামড়ার প্রায় ৩০ শতাংশ প্রতিবছর নষ্ট হয়ে যায়, যার মূল কারণ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব এবং অর্থসংকট।”

ঋণ বিতরণে বৈষম্যের অভিযোগ

চামড়া ব্যবসায়ী আজম মিয়া জানান, ব্যাংকগুলো কেবল ট্যানারি মালিক ও রপ্তানিকারকদের ঋণ দেয়। অথচ আড়তদার ও মৌসুমি উদ্যোক্তারা যাঁরা মূলত কাঁচা চামড়া সংগ্রহের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাঁরা এই আর্থিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। ফলে চামড়ার অপচয় ঠেকানো সম্ভব হয় না।

সরকার ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের অবস্থান

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এবারের ঈদে চামড়া সংরক্ষণের লক্ষ্যে এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ সরবরাহ করা হয়েছে।

জনতা ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ট্যানারি ব্যবসায়ীরা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফশিল করতে চান না, ফলে বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও ঋণ বিতরণ ব্যাহত হয়।”

সোনালী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, “ব্যবসায়ীদের ঋণ ফেরতের সদিচ্ছার অভাবের কারণে ব্যাংকগুলো দিনে দিনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ফলে চামড়া খাতে ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে।”

দাম নির্ধারণেও রয়েছে অসন্তোষ

চলতি মৌসুমে সরকার ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। ঢাকার বাইরে এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। সর্বনিম্ন গরুর চামড়ার মূল্য ঢাকায় ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

খাসি ও বকরির চামড়ার দাম যথাক্রমে প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা ও ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে অনেক এলাকায় এই দামে বিক্রি হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

রপ্তানি সম্ভাবনা হুমকির মুখে

চামড়া শিল্প থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে। অথচ চলমান আর্থিক সংকট ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতায় এই খাতের রপ্তানি সম্ভাবনা বড় হুমকির মুখে পড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চামড়া খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি বাস্তবসম্মত আর্থিক পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে। ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, স্বচ্ছ ঋণ বিতরণ, আড়তদারদের অন্তর্ভুক্তি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এই শিল্পকে রক্ষা করা সম্ভব।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button