মানুষের জীবনে ভাগ্য একটি গভীর ও রহস্যময় বিষয়। পবিত্র কোরআনের আলোকে এই ভাগ্য বা তাকদির সম্পর্কে মুসলমানদের বিশ্বাস থাকা ঈমানের একটি অপরিহার্য অংশ। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন ও মৃত্যুর প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর নির্ধারিত পরিকল্পনার অন্তর্গত। এই বিশ্বাস মুমিনদের মধ্যে এক গভীর আত্মসমর্পণ ও তাওয়াক্কুল সৃষ্টি করে।
তাকদির মানা ঈমানের অংশ
পবিত্র কোরআন স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে, ভাগ্যে বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন হতে পারে না। অর্থাৎ, জীবনযাত্রার প্রতিটি ঘটনা—সুখ, দুঃখ, বিপদ, মৃত্যু, সফলতা কিংবা ব্যর্থতা—সবই আল্লাহ তাআলার পূর্ব নির্ধারিত নির্দেশনা অনুযায়ী সংঘটিত হয়।
আল্লাহ বলেন:
“আমি সব কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে, আমার আদেশ তো একটি কথায় নিষ্পন্ন, চোখের পলকের মতো।”
— (সুরা কামার, আয়াত ৪৯-৫০)
তাকদির আল্লাহর গোপন রহস্য
তাফসিরবিদদের মতে, ভাগ্য বা তাকদির এমন এক অদৃশ্য জগৎ, যার পূর্ণ সত্য কেবল আল্লাহই জানেন। তিনি কারো কাছে তার পূর্ণ ব্যাখ্যা প্রকাশ করেননি, বরং ইচ্ছামতো কিছু রাসূলকে কিছু তথ্য দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেন:
“অদৃশ্য সম্পর্কে তোমাদেরকে আল্লাহ অবহিত করার নয়; তবে আল্লাহ তাঁর রাসুলদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন।”
— (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৭৯)
আল্লাহই ভাগ্যের নির্ধারক
মানুষ যা অর্জন করে বা যা হারায়, তার সবই আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনার অধীন। এমনকি কোনো বিপদ বা সুখের মুহূর্ত ঘটার আগে থেকেই তা আল্লাহর কাছে লিপিবদ্ধ থাকে।
আল্লাহ বলেন:
“পৃথিবীতে কিংবা তোমাদের নিজেদের ওপর যা কিছু বিপদ আসে, তা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই তা কিতাবে (লাওহে মাহফুজে) লিপিবদ্ধ থাকে। আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ।”
— (সুরা হাদিদ, আয়াত ২২)
ভাগ্যে বিশ্বাস মানে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ধৈর্য
ভাগ্যে বিশ্বাস একজন মুমিনকে ধৈর্যশীল ও আত্মনিয়ন্ত্রিত করে তোলে। সে বুঝে, জীবনে যা হারায়, তা তার নিয়তিতে ছিল না; এবং যা পেয়েছে, তাও আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে।
আল্লাহ বলেন:
“এটা (ভাগ্য নির্ধারণ) এ জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন বিমর্ষ না হও, আর যা তোমাদের দিয়েছেন তাতে অহংকারী না হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারীদের ভালোবাসেন না।”
— (সুরা হাদিদ, আয়াত ২৩)
কোনো কিছুই আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে নয়
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, এমন কোনো ঘটনা নেই যা আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া ঘটে। এমনকি একটি পাতা গাছ থেকে পড়ে গেলেও তা আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে নয়।
আল্লাহ বলেন:
“জলে ও স্থলে যা কিছু আছে, সবই তিনি জানেন। এমনকি তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মাটির অন্ধকারে এমন কোনো শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না… যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।”
— (সুরা আনআম, আয়াত ৫৯)
সাহাবিদের শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত
উবাই বিন কাব (রা.)-এর নিকট আবু আবদুল্লাহ ইবনে দায়লামি (রহ.) একবার তার মনের বিভ্রান্তির কথা জানালে, তিনি স্পষ্টভাবে বলেন যে, তাকদিরে বিশ্বাস না থাকলে মানুষের সব আমল বাতিল হয়ে যেতে পারে—even যদি কেউ উহুদ পাহাড় সম পরিমাণ স্বর্ণ দান করে।
তিনি বলেন:
“তুমি যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করো কিন্তু তাকদিরে বিশ্বাস না রাখো, তবে তা কবুল হবে না যতক্ষণ না তুমি বুঝো—যা তোমার জন্য নির্ধারিত ছিল, তা কখনোই এড়ানো যেত না। আর যা তোমার হয়নি, তা কখনোই হতো না।”
— (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৬৯৯)
মুমিন সব অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকে
একজন প্রকৃত মুমিন ভাগ্যের ভালো-মন্দ সব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা হিসেবে গ্রহণ করে। কোনো দুঃখজনক ঘটনা হলেও সে প্রশ্ন তোলে না, বরং ধৈর্য ধারণ করে।
আল্লাহ বলেন:
“তিনি যা করেন, সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না; বরং মানুষকেই প্রশ্ন করা হবে।”
— (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ২৩)
তাকদিরে বিশ্বাসের উপকারিতা
- জীবনে আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শান্তি আসে
- দুঃখে হতাশ না হয়ে আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখে
- অহংকার থেকে দূরে থাকে
- ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার গুণাবলি গড়ে ওঠে
- ইবাদতে আন্তরিকতা আসে, কারণ সে জানে, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়
উপসংহার
পবিত্র কোরআনের শিক্ষায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় যে, ভাগ্য এক রহস্যময় বাস্তবতা—যা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। তাকদিরে বিশ্বাস শুধু একটি ধর্মীয় আদর্শ নয়; এটি একজন মুসলমানের জীবনদর্শন। এজন্য আমাদের উচিত ভাগ্যের ভালো-মন্দ উভয়কেই আল্লাহর পক্ষ থেকে ধরা, তাতে সন্তুষ্ট থাকা, এবং কোনো অবস্থায় ধৈর্য ও বিশ্বাস হারিয়ে না ফেলা।
শেষ কথা
তাকদিরে বিশ্বাস রাখা শুধু ঈমানের শর্ত নয়, বরং একজন মুমিনের মানসিক শক্তির উৎস। এটি অন্তরের প্রশান্তি এনে দেয় এবং জীবনকে আল্লাহর ওপর নির্ভরতার সাথে চালিয়ে যেতে সহায়তা করে।
এম আর এম – ০২৬০, Signalbd.com



