বানিজ্য

বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে এক নম্বরে উঠতে প্রস্তুত বাংলাদেশ

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বিশ্বের বাণিজ্য মানচিত্রে এক উল্লেখযোগ্য অবস্থান অর্জন করেছে। বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে অবস্থান করা বাংলাদেশের সামনে এখন নতুন লক্ষ্য—বিশ্বে এক নম্বর হওয়ার। এই লক্ষ্য অর্জন যে অসম্ভব নয়, বরং সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত, সে কথা আবারও মনে করিয়ে দিলেন কোরিয়ান ইপিজেডের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট বিনিয়োগকারী কিয়াক সুং।

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে অনুষ্ঠিত “বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন”–এর “টেক্সটাইল ও পোশাক” বিষয়ক অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। “বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ” শীর্ষক অধিবেশনে মূল বক্তা হিসেবে তিনি বলেন, “সঠিক কৌশল, কার্যকর সংস্কার এবং উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে পোশাক রপ্তানির এক নম্বর স্থানে পৌঁছাতে সক্ষম।”

বাংলাদেশ: পোশাক শিল্পে সম্ভাবনার নাম

বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। শত শত কারখানায় লাখ লাখ শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে তৈরি করছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পোশাক, যা বিশ্বের শতাধিক দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এই খাত থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করছে বাংলাদেশ। তবে এক নম্বরে পৌঁছাতে হলে এই অর্জনকে আরও সম্প্রসারিত করার বিকল্প নেই।

কিয়াক সুং-এর ভাষায়, “বাংলাদেশ এখন এককভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। তবে এই অর্জনকে আমরা শিখরের দিকে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য আমাদের দরকার কৌশলগত প্রযুক্তি ব্যবহার, শ্রমিকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, এবং কাঁচামালের উৎপাদনে স্বনির্ভরতা।”

প্রযুক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব

কিয়াক সুং তার বক্তব্যে বিশেষভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার ও মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর জোর দেন। তার মতে, আগামী দিনগুলোতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হবে। তাই উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, “বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ যন্ত্রপাতির ব্যবহার, স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং দক্ষ শ্রমশক্তি ছাড়া গুণগত মান রক্ষা সম্ভব নয়। এইসব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে নজর দিতে হবে। পোশাক শিল্পে শুধু পরিমাণ নয়, মানই এখন সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতার বিষয়।”

কাঁচামাল সরবরাহ ও নীতি সহায়তার প্রয়োজনীয়তা

পোশাক উৎপাদনের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো কাঁচামাল সংগ্রহ। অধিকাংশ সময় বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, যা সময় ও খরচ বৃদ্ধি করে। এ বিষয়ে কিয়াক সুং বলেন, “দেশীয়ভাবে সুতা ও ফেব্রিক উৎপাদনের জন্য আমাদের নিজস্ব উৎপাদন সুবিধা গড়ে তুলতে হবে। এতে সময় ও ব্যয়ের সাশ্রয় হবে এবং উৎপাদন ধারাবাহিকতা নিশ্চিত হবে।”

তাছাড়া তিনি বন্ডেড গুদামের সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন। “বিপুল সংখ্যক বন্ডেড গুদাম থাকলে দ্রুত কাঁচামাল সরবরাহ সম্ভব হবে, যা উৎপাদন ও রপ্তানিতে গতি আনবে,” বলেন কিয়াক সুং।

ট্রেড পলিসি ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে চালু হওয়া কিছু শুল্কনীতি নিয়ে কথা বলেন এবং সাম্প্রতিক তিন মাসের স্থগিতাদেশকে স্বস্তিদায়ক হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়ে সক্রিয়ভাবে যে ভূমিকা পালন করেছে তা প্রশংসনীয়। এই উদ্যোগ আরও জোরালোভাবে চালিয়ে যেতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের শুল্কনীতির পরিবর্তন আমাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি না করে।”

মূল্য সংযোজন ও উচ্চমানের পোশাক উৎপাদনের প্রতি আহ্বান

বাংলাদেশের পোশাক খাত এখনো তুলনামূলকভাবে কম দামে তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। কিয়াক সুং মনে করেন, বিশ্ববাজারে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে উচ্চমূল্যের, প্রযুক্তি-নির্ভর ও নকশায় বৈচিত্র্যপূর্ণ পোশাক উৎপাদনের দিকে যেতে হবে।

তিনি বলেন, “আমাদের এখন থেকে উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদনে মনোযোগ দিতে হবে। যেমন—স্পোর্টসওয়্যার, ফ্যাশনেবল পোশাক, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কাপড় ইত্যাদি। এগুলোর বাজার চাহিদা বাড়ছে এবং এদের রপ্তানি মূল্যও অনেক বেশি।”

সরকারের উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা

এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ’র প্রশাসক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে পোশাক শিল্পে বহুমাত্রিক নীতি সহায়তা প্রদান করছে। বিশেষ করে দক্ষতা উন্নয়ন, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি প্রণোদনা আরও বাড়ানো হয়েছে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আগামী দিনে এই খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্মার্ট ফ্যাক্টরি ও রোবটিক্স প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। সরকার এ বিষয়ে নীতিগত সহায়তা ও বিনিয়োগ আকর্ষণে আগ্রহী।”

উপসংহার

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আজ আর কেবল শ্রমনির্ভর শিল্প নয়, এটি একটি কৌশলগত রপ্তানি খাত। কিয়াক সুং-এর মত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের বক্তব্য প্রমাণ করে যে, বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা এখনো বিপুল। তবে এই সম্ভাবনাকে পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা, নীতিগত সহায়তা এবং সর্বোপরি মানসম্পন্ন উৎপাদনে মনোযোগ।

বাংলাদেশ যদি প্রযুক্তি ও দক্ষতাভিত্তিক আধুনিক পোশাক শিল্প গড়ে তুলতে পারে, তবে বিশ্বে এক নম্বর রপ্তানিকারক হওয়ার স্বপ্ন আর দূরের কিছু নয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button