বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৪ (জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ) আসনে তাদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বুধবার রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে ভার্চুয়ালি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে যুক্ত হয়ে এই মনোনয়ন ঘোষণা করেন। বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন এবং সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন নেতাকর্মীর মতামতও গ্রহণ করা হয়।
আরিফুল হক চৌধুরী—দলের ‘বিশ্বস্ত সৈনিক’
মনোনয়ন ঘোষণার পর আরিফুল হক চৌধুরী গণমাধ্যমে বলেন,
“আমি কখনো দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করিনি, ভবিষ্যতেও করব না। চেয়ারপারসনের নির্দেশই আমার রাজনৈতিক জীবনের দিকনির্দেশনা। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।”
তিনি আরও বলেন, “দলের সিদ্ধান্তে সিলেট-৪ আসন থেকে প্রার্থী হচ্ছি। জনগণের ভালোবাসা ও আস্থা আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। আমি চাই, সিলেটবাসী বিএনপির পাশে দাঁড়াক—গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের এই লড়াইয়ে।”
ঢাকা সফর ও সিদ্ধান্তের পটভূমি
বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) জরুরি তলবে ঢাকায় যান আরিফুল হক চৌধুরী। সেখানে তার সঙ্গে দলের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েক দফা বৈঠক হয়।
বুধবার রাত ৯টার দিকে চূড়ান্ত বৈঠকে তাকে সিলেট-৪ আসনের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র প্রদান করা হয়। দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদসহ একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা এই প্রক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, সিলেট অঞ্চলে বিএনপির শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে এবং স্থানীয় নেতাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সিলেট-৪ আসন: ঐতিহ্য, ইতিহাস ও রাজনৈতিক গুরুত্ব
সিলেট-৪ আসনটি দেশের অন্যতম রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা। পাহাড়, নদী ও প্রবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসছে।
এই আসনে প্রবাসী ভোটারদের প্রভাবও যথেষ্ট। অনেক ভোটার যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করলেও তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেন।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়ী হলেও বিএনপি এখানে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তাই ২০২৫ সালের নির্বাচনে এই আসনকে ঘিরে আবারও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
আরিফুল হকের জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক যাত্রা
সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী শুধু একজন রাজনীতিক নন, তিনি সিলেটবাসীর কাছে পরিচিত একজন সেবকনেতা হিসেবেও।
তিনি প্রথম নির্বাচিত হন ২০১৩ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালেও জনগণের ভোটে পুনর্নির্বাচিত হন। তার মেয়াদকালে সিলেট শহরে অবকাঠামো উন্নয়ন, সড়ক সংস্কার ও নগর ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন আসে।
দলের কঠিন সময়েও তিনি বিএনপির সঙ্গে থেকেছেন, আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন এবং কারাবরণ করেছেন।
তারেক রহমানের ভার্চুয়াল ঘোষণা: নতুন দিকনির্দেশনা
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন,
“আরিফুল হক চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে দলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। তার প্রতি সিলেটবাসীর আস্থা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি জনগণের পাশে থেকে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত করবেন।”
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তারেক রহমান সিলেটসহ দেশের সব অঞ্চলে জনপ্রিয়, ত্যাগী ও সংগঠিত নেতাদের প্রাধান্য দিচ্ছেন। এজন্যই আরিফুল হককে পুনরায় সক্রিয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আনা হয়েছে।
নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাস ও প্রত্যাশা
মনোনয়ন ঘোষণার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সিলেট শহর ও জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট অঞ্চলে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন বার্তা প্রকাশ করেন।
জৈন্তাপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি বলেন,
“আরিফ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ। তিনি সিলেটের গর্ব। জনগণের ভালোবাসা তার প্রতি অগাধ।”
গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক বলেন,
“আমরা ইতিমধ্যেই মাঠে নেমেছি। ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাইব। আমাদের বিশ্বাস, জনগণ বিএনপিকে বিজয় উপহার দেবে।”
আগামী নির্বাচনে বিএনপির কৌশল ও চ্যালেঞ্জ
বিএনপি ইতিমধ্যে বিভিন্ন আসনে ধাপে ধাপে প্রার্থী ঘোষণা শুরু করেছে। ২০২৫ সালের নির্বাচনে তারা “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের সরকার” স্লোগান নিয়ে অংশ নিচ্ছে।
সিলেট বিভাগে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। কারণ, সিলেট সব সময় বিএনপির অন্যতম দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রবাসী রাজনীতি, ধর্মীয় প্রভাব ও ঐতিহাসিকভাবে জাতীয়তাবাদী ধারা রয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দলকে স্থানীয় পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ রাখা, ভোটকেন্দ্র রক্ষা করা এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই হবে বিএনপির বড় পরীক্ষা।
স্থানীয় ভোটারদের প্রত্যাশা
সিলেট-৪ আসনের সাধারণ ভোটারদের মতে, তারা এমন একজন প্রার্থী চান যিনি এলাকার উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করবেন।
গোয়াইনঘাটের এক শিক্ষক বলেন,
“আরিফুল হক মেয়র হিসেবে ভালো কাজ করেছেন। এখন সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলে আশা করি, আমাদের এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করবেন।”
কোম্পানীগঞ্জের এক তরুণ ভোটার বলেন,
“আমরা পরিবর্তন চাই। বিএনপি এবার যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে জয় অসম্ভব নয়।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: কেন গুরুত্বপূর্ণ এই আসন
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সিলেট-৪ আসন শুধু একটি সংসদীয় এলাকা নয়, এটি বিএনপির রাজনৈতিক শক্তিমত্তার প্রতীকও।
একজন স্থানীয় বিশ্লেষক বলেন,
“আরিফুল হক চৌধুরী শুধু জনপ্রিয় প্রার্থীই নন, তিনি দলের জন্য ত্যাগীও। তাই তার প্রার্থিতা সিলেটে বিএনপির আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।”
অন্যদিকে আওয়ামী লীগও এই আসনে শক্ত প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে আসন্ন নির্বাচনে এই আসনটি হবে একটি হাই-প্রোফাইল প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্র।
সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও আলোচনার কেন্দ্রে আরিফুল হক চৌধুরী। বিএনপির এই মনোনয়ন ঘোষণার মধ্য দিয়ে নতুন করে জমে উঠছে নির্বাচনী হাওয়া।
জনগণের প্রত্যাশা, রাজনীতিতে যেন শালীনতা, উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
এখন দেখার বিষয়, সিলেট-৪ আসনে বিএনপির এই সিদ্ধান্ত কতটা সফল হয়, এবং আরিফুল হক চৌধুরী আবারও ভোটের মাঠে জনগণের আস্থা কতটা অর্জন করতে পারেন।
MAH – 13644 I Signalbd.com



