শেখ হাসিনাসহ পরিবারের ৫৩ সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং ভাগনি ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকসহ পরিবারের একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালত। প্লট বরাদ্দে অনিয়ম এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে দুদকের করা পৃথক তিনটি মামলার ভিত্তিতে এই আদেশ দেওয়া হয়েছে।
রোববার (১৩ এপ্রিল) ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন এ আদেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দাখিল করা অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার পর বিচারক এই আদেশ প্রদান করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্তরা সবাই বর্তমানে পলাতক থাকায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
প্লট বরাদ্দে জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার
দুদক থেকে জানানো হয়, রাজধানীর পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬০ কাঠা জমি দুর্নীতির মাধ্যমে বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে এই মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে। মোট ১০ কাঠা করে ছয়টি প্লট শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে বরাদ্দের ঘটনায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তদন্ত শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানে উঠে আসে, বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় গুরুতর অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ঘনিষ্ঠতাভিত্তিক সুবিধা গ্রহণের প্রমাণ।
২০২৫ সালের ১০ মার্চ এই ঘটনায় ছয়টি মামলা দায়েরের অনুমোদন দেয় দুদকের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। পরে ধারাবাহিকভাবে এসব মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়।
অভিযোগপত্রে যাঁদের নাম আছে
দুদক যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
- শেখ হাসিনা
- সজীব ওয়াজেদ জয় (পুত্র)
- সায়মা ওয়াজেদ পুতুল (কন্যা)
- শেখ রেহানা (বোন)
- টিউলিপ সিদ্দিক (ভাগ্নি ও ব্রিটিশ এমপি)
- রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি (ভাগ্নে)
- আজমিনা সিদ্দিক (আরও এক ভাগ্নি)
এর বাইরেও বিভিন্ন আমলা, রাজউক কর্মকর্তাসহ মোট ৫৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ
আদালত বলেছেন, অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা বর্তমানে পলাতক অবস্থায় রয়েছেন এবং মামলার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা প্রয়োজন। এ ছাড়া আদালত মামলাগুলোর পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে এবং পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে আসামিদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করতে।
আগের মামলায়ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
এর আগে, একই প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির আরেকটি মামলায় শেখ হাসিনা ও তাঁর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে ১০ এপ্রিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন আদালত। এখন মোট ছয়টি মামলার মধ্যে চারটিতে শেখ হাসিনাসহ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি আদেশ হয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনের পটভূমি
২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে। এর পর থেকেই তাঁর ও পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগে মামলা দায়ের হতে থাকে।
ঢাকার বিভিন্ন থানায় এবং আদালতে ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিন শতাধিক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই দায়ের হয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় ও রাজনৈতিক দমন–পীড়নের অভিযোগে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও প্রতিক্রিয়া
এ ধরনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলেও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও কিছু পশ্চিমা দেশের পর্যবেক্ষক দল এই মামলাগুলোর স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কড়া নজরদারি চালাচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী টিউলিপ সিদ্দিক, যিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির সদস্য, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কিছুটা আলোড়ন তুলেছে।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির দিকনির্দেশনা
বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলার ফলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। অনেকে বলছেন, এই মামলাগুলোর মাধ্যমে শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক প্রভাব বলয় ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার কাঠামোকেও ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।
বর্তমানে যে রাজনৈতিক ও বিচারিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য অধ্যায় হয়ে থাকবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ ধরনের জিরো টলারেন্স নীতি একদিকে যেমন রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করে, অন্যদিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নির্ভর করবে তদন্তের স্বচ্ছতা, বিচারিক প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।